শিরোনাম
◈ দাম বেড়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের, কমেছে মুরগির  ◈ ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন শেষ করতে চায় পেট্রোবাংলা ◈ ভিত্তিহীন মামলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের নাজেহাল করা হচ্ছে: মির্জা ফখরুল ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী ◈ অপরাধের কারণেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের  বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী  ◈ অ্যাননটেক্সকে জনতা ব্যাংকের সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি  ◈ ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ ইরানে ইসরায়েলের হামলার খবরে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক ◈ বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বাস ঢু‌কে প্রকৌশলী নিহত

প্রকাশিত : ০৭ জানুয়ারী, ২০২০, ০১:৩৭ রাত
আপডেট : ০৭ জানুয়ারী, ২০২০, ০১:৩৭ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

পানিতে সাঁতার কেটে স্কুলে যায় দরিদ্র পরিবারের চার কন্যা!!

মুসবা তিন্নি : বন্যা ও পানি থৈথৈ খাল হার মেনেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা তীরের চান্দুপাড়া গ্রামের চার কিশোরীর কাছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে এসে জানাচ্ছেন আহসান হাবিব।

প্রতিদিন দুটো খাল পেরিয়ে স্কুলে যায় তারা। বন্যার কারণে নতুনপাড়া গ্রাম থেকে চান্দুপাড়া ও আশপাশের পাঁচটি বিদ্যুত্হীন গ্রাম যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। তাই শনিবার নতুন গ্রামে পৌঁছলেও নৌকা না থাকায় আমার পক্ষে ওপাড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নতুন গ্রামে আমার পৌঁছার খবর পেয়ে সাঁতার কেটে সদর উপজেলার চান্দুপাড়া থেকে নতুন গ্রামে স্কুলে যাওয়ার মতো করেই ছুটে আসে নদীপারের অতিদরিদ্র পরিবারের চার শিক্ষার্থী রুনা লাইলা, সুলতানা খাতুন, পারুল ও তাসলিমা খাতুন। তারা অনুপনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। বলল নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ও সাঁতার কেটে স্কুলে যাতায়াতের গল্প। বাড়ি ও গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় ঘরে ফিরে দিনের আলোতেই স্কুল ও পরীক্ষার লেখাপড়া সেরে ফেলতে হয় তাদের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী সড়কে জেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে এবং বাসুদেবপুর থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে অনুপনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থান। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুলটি। এর পশ্চিমে পৌনে এক কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ৭ নম্বর চর অনুপনগর ইউনিয়নের বিদ্যুত্হীন ‘নতুনপাড়া গ্রাম’। এ গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে মহানন্দা নদীতীরে চান্দুপাড়া গ্রাম। নতুনপাড়া গ্রামের শেষ মাথা থেকে চান্দুপাড়া পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে আছে। বন্যার পানি কমে এলেও চান্দুপাড়া ও টিকরাপাড়া দুটি খালের পানি সরে যেতে সময় লাগে আরো দুই মাস। চান্দুপাড়া থেকে নতুন গ্রামে বা শুকনো জায়গায় পৌঁছতে কোনো নৌকার ব্যবস্থা নেই। গ্রামের এক হাজার মানুষকে সদর উপজেলায় বা নতুন গ্রামে আসতে হয় সাঁতার কেটেই। চান্দুপাড়ার এই মেয়েদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার, সে হিসেবে আসা-যাওয়া মিলিয়ে পাঁচ কিলোমিটার যাতায়াত করতে হয় তাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে। এর মধ্যে পড়ে ৮০০ ফুট প্রশস্ত পানি থৈথৈ দুটি খাল। নৌকা না থাকায় সাঁতরেই খাল পেরিয়ে স্কুলে যায় রুনা লাইলা, সুলতানা খাতুন, পারুল ও তাসলিমা খাতুন। এলাকাবাসী ও নদীপারের এই চার ছাত্রীর দাবি—বর্ষা ও বন্যা মৌসুমে চার মাসের জন্য পারাপারের নৌকার ব্যবস্থা বা দুটি খালে কালভার্ট নির্মাণ। অনেক কথাই হলো এই চার কিশোরীর সঙ্গে।

রুনা লাইলার বাবার নাম শরিফুল ইসলাম। তারা তিন ভাই ও দুই বোন। এদের মধ্যে রুনা পড়ে অনুপনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে। তাদের খাল পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া বিষয়টা বিস্তারিত বলল সে। যখন তারা চারজন স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, তখন স্কুলের ড্রেস, বই, খাতা-কলম একটি বড় অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িতে রেখে মাথায় করে হাঁটতে শুরু করে। খালের কাছে আসার পর অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িটি পানিতে ভাসায় এবং কিনারে না পৌঁছা পর্যন্ত হাঁড়িটি সযত্নে দুই হাত দিয়ে ধরে রেখে সাঁতার কাটতে থাকে। এভাবে বন্যা ও পরবর্তী দুটো মাস ভীষণ কষ্ট করেই যাতায়াত করতে হয় স্কুলে। সাঁতার কেটে কিনারে উঠে আরো কিছুদূর হেঁটে নতুনগ্রামে পৌঁছে। তারপর কারো বাড়িতে গিয়ে হাঁড়িতে থাকা স্কুল ড্রেসটি পরে। কখনো স্কুলেও ড্রেস বদল করে। ক্লাস শেষ করে আবারও স্কুল ড্রেস বদলে আধ ভেজা পোশাকটি পরে বাড়ির দিকে রওনা হয়।

তাসলিমা খাতুন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। তার বাবা আবুল কাশেম মারা গেছেন আট বছর আগে। তারা পাঁচ ভাই ও চার বোন। আবুল কাশেম ছিলেন কৃষি শ্রমিক।

কাছ থেকে জানতে পারলাম, তারা চারজন সাঁতার কেটে স্কুলে গেলেও সাঁতার না জানায় একই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া তাদের এলাকার ফাতিমা, শারমিন ও ইয়াসমিন স্কুলে যেতে পারে না। প্রায় চার মাস ওদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। তাসলিমার বিকল্প প্রস্তাব, এই চার মাসে স্কুলের আশপাশে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কেউ করে দিলে এমন ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হবে না।

কেন এত বাধা পেরিয়েও স্কুলে যায় জানতে চাইলাম। বলল, তার বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই পরিবারের কথা ভেবে বিদেশে গিয়েছেন। তিনি বাড়িতে যে টাকা পাঠান তা যথেষ্ট নয়। দারিদ্র্যের কারণে তৃতীয় শ্রেণিপড়ুয়া ছোট ভাই ছাড়া তাসলিমার ভাই-বোনদের কেউ স্কুলে যায়নি এবং তার তিন বোনের খুব কম বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। তাসলিমা বলে, আমরা খুব গরিব, তবু আমি নিজেকে শিক্ষিত করতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। যেন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে পারি।

সুলতানা ও পারুল তামলিমার সঙ্গে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তারাও একেবারে দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিন্তু পড়ালেখার আগ্রহ খুব। কৃষি শ্রমিক আব্দুল মান্নানের মেয়ে পারুলরা ভাই-বোন ছয়জন। এদিকে সুলতানার বাবা গোলাম মোস্তফাও কৃষি শ্রমিক। সুলতানারা ভাই-বোন তিনজন। তাদের কারো বাড়িতেই নেই সৌর বিদ্যুৎ। আলাপ হলো দুই অভিভাবক গোলাম মোস্তফা ও আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। দুজনের একই কথা। দুটি খাল সাঁতার কেটে মেয়েরা স্কুলে যাওয়ায় মনটা যেমন ভরে ওঠে, তেমনি ডুবে যাওয়ার ভয়ে আতঙ্কে তটস্থ থাকি সারাক্ষণ।

নতুনপাড়া গ্রামের অধিবাসী আব্দুল কাদের জানান, নৌকা না থাকায় চান্দুপাড়া গ্রামের প্রায় ৫০০ মানুষকে সাঁতার কেটেই যাতায়াত করতে হয়।

৭ নম্বর চর অনুপনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সাইদুর রহমান বললেন, টিকরাপাড়া ও চান্দুপাড়ায় দুটি কালভার্ট না থাকায় মুসলিমপাড়া, আকালুপাড়া, টিকরাপাড়া, ফারুকপাড়ার অনেকেই পঞ্চম শ্রেণি পাস করলেও পাশের স্কুল অনুপনগরে ভর্তি না হতে পেরে ঝরে পড়ে। সাঁতার কেটে চারটি মেয়ে যেভাবে প্রতিদিন লেখাপড়ার জন্য যাতায়াত করে, তা অনন্য দৃষ্টান্ত; দেশে এমনটি আর আছে কি না জানা নেই। প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি টিকরাপাড়া ও চান্দুপাড়ায় দুটি কালভার্ট নির্মাণের জন্য। নির্মাণ হলে এবং বড় বন্যা না হলে পায়ে হেঁটেই শিক্ষার্থীরাসহ ওই এলাকার প্রায় এক হাজার মানুষ স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারবে।

সমস্যাটার বিষয়ে চর অনুপনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম বাচ্চুর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বললেন- চান্দুপাড়া, মুসলিমপাড়া, আকালুপাড়া, ফারুকপাড়া ও টিকরাপাড়া গ্রাম চরের নিচু এলাকা। বন্যায় পানি উঠে এখানকার ফসলি জমিতে। প্রয়োজন থাকলে অবশ্যই কালভার্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেব। কোথাও কোথাও জমি আরো নিচু হওয়ায় পানি সরতে দেরি হয়। টিকরাপাড়া ও চান্দুপাড়া গ্রামের নিচে জোলায় (খাল) বন্যার পানি জমলেও বেশীদিন থাকেনা।

কথা হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। বললেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজন থাকলে অবশ্যই কালভার্ট নির্মাণ বা অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে সমস্যার বিষয়টি এর আগে জানা ছিল না এবং কেউ জানায়ওনি।

অনুপনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহতাব উদ্দিন বলেন, খাল পেরিয়ে আসতে হলেও রুনা, পারুল, সুলতানা ও তাসলিমা ক্লাস মিস করে না। প্রতিদিন দুবার করে খাল পার হওয়া আসলেই অসাধারণ এক ঘটনা। হাঁটা ও সাঁতার কাটা মিলিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার পথ পেরোতে হয় এই মেয়েদের। তারা বিদ্যালয়ের গর্ব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়