নিউজ ডেস্ক: বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, হেফাজতে নির্যাতন, নারী নির্যাতন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সংগঠনটি মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ উদ্বেগ প্রকাশ করে। বাংলা ট্রিবিউন
আসকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ২০১৯ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৩৮৮ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। তাই এপর্যন্ত সংঘটিত সব গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
বিগত একবছরে (২০১৯) দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে আসকের লিখিত প্রতিবেদন পড়ে শোনান সংগঠনটির সিনিয়র উপপরিচালক নিনা গোস্বামী ও আবু আহমেদ ফয়জুল কবির। এর আগে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো তুলে ধরেন সংগঠনটির নির্বাহী পরিষদের মহাসচিব তাহমিনা রহমান। পরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা।
আসকের একবছরের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবছরেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো ঘটনা অব্যাহত ছিল। ২০১৯ সালে গুমের অভিযোগের সংখ্যা কিছুটা কমে এলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ার, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুসহ গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনা ছিল বছরজুড়ে। ২০১৮ সালের মে মাস থেকে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনা অব্যাহত ছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে অনেক বাংলাদেশি নাগরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
আসকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম থাকলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল বরাবরের মতোই নাজুক। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে ছেলেধরা গুজবকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন অনেক নিরীহ মানুষ।
মত প্রকাশের অধিকারের ক্ষেত্রেও এবছরের চিত্র ছিল উদ্বেগজনক। মত প্রকাশ ও সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়াসহ সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে বছরটিতে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকসহ অনেক সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা ও হয়রানি ছিল বছরজুড়ে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার ওপর হামলাসহ নির্যাতনের ঘটনা দেখা গেছে এ বছরটিতে।
আরো পড়ুন
ছাত্রদলের নেতৃত্বেই গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হবে, প্রত্যাশা মির্জা ফখরুলের
নারীর প্রতি সহিংসতা ছিল অন্যতম একটি উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নির্যাতন ও হত্যার মতো ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাসহ শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বছরজুড়ে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতায় নিরাপরাধ জাহালমের কারাভোগ ও ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে কারাগারে প্রবেশ ও ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বামদলের নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের হামলার বিষয়টিও তুলে ধরা হয় এই প্রতিবেদনে।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু : ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া, গ্রেফতারের আগে নির্যাতনে মারা যান ছয় জন এবং গুলিতে নিহত হয়েছেন ১২ জন।
সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন : ২০১৯ সালে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলি ও শারীরিক নির্যাতনে ৪৭ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ : এবছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ,গুম ও নিখোঁজ হয়েছেন ১৩ জন। এরমধ্যে পাঁচ জনের সন্ধান পাওয়া গেলেও আট জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনও।
রাজনৈতিক সহিংসতা : এবছর রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩৯ জন নিহত ও দুই হাজার ৬৮৯ জন আহত হয়েছেন। বরগুনায় প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা ও প্রধান সাক্ষী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে আসামি করার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় আসকের প্রতিবেদনে।
গণপিটুনি : এবছর গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ৬৫ জন। বিষয়টি আইনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতারই প্রকাশ পেয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন : গত বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৪১৩ জন নারী। এরমধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন নারী। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৫৮ জন নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪৪ জন পুরুষ নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। উত্ত্যক্তে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৮ জন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে চার জন নারীসহ খুন হয়েছেন ১৭ জন। সালিশের নামে নির্যাতন করা হয়েছে চার জন নারীকে। এঘটনায় পরে ক্ষোভে একজন আত্মহত্যা করেছেন। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৬৭ জন নারী। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ৯৬ জন। আত্মহত্যা করেছেন তিন জন। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪২৩ জন নারী। গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৪ জন।
শিশু নির্যাতনের ঘটনাও ছিল উদ্বেগজনক। এবছর শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ৪৮৭ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে একহাজার ৮৭টি শিশু। ৩৭টি ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, রাষ্ট্র ও সমাজের সবক্ষেত্রে সমঅধিকার নিশ্চিত করা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেনো স্বাধীনভাবে তাদের ম্যান্ডেট বাস্তবায়ন করতে পারে, সরকার যেনো এ বিষয়ে সহযোগিতা ও গুরুত্ব দেয়, সেজন্য মানবাধিকার প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :