নিউজ ডেস্ক : আমার যা ক্ষতি হয়েছে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তার ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে না। এখন আমার কিছু নাই, আমি বেকার। এভাবেই দুঃখের কথা বলছিলেন আব্দুস সাত্তার। তার বাড়ি কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার মধুরছড়ায়। মানবজমিন
তিনি বলেন, আমার বাড়ির চারপাশে সবজি আবাদ করতাম। এখন সে জায়গায় শুধুই বাড়ি। আমার গরু ছিলো ২০টার মতো। পাহাড়ের টিলায় ছেড়ে দিতাম। এখন কিছুই নাই। ঘাসের স্থানে শুধুই ক্যাম্প। ৮ একর জমিতে ধান আবাদ করতাম। এখন কিছুই নাই। সব গেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নির্মাণ করা হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া।
এই বেড়ার মধ্যে যেসব স্থানীয় বাঙালি পরিবারের বাড়ি পড়ছে তারা সবাই আছেন নানা সমস্যায়। দীর্ঘ সময় ধরে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে স্থানীয়দের এমন সমস্যার পাশাপাশি ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারাও বলছেন, তাদের ক্যাম্প জীবন দীর্ঘায়িত হওয়ায় সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে চিন্তার ভাঁজ। সন্তানদের চিকিৎসা, ভবিষ্যৎ এসব নিয়ে তারা চিন্তিত। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আশার আলো খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। এতে তাদের চিন্তাও বাড়ছে। কেউ কেউ ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন নানাভাবে। যদিও তাদের ওপর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তদারক প্রতিষ্ঠানের কড়া নজরদারি রয়েছে।
ক্যাম্প এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, এখন ক্যাম্পে ৫টার পর অন্য লোক ঢুকতে পারে না। মালেক মিয়া বলেন, আমার বাড়ির উঠানে ৩টা রোহিঙ্গা ঘর। আমার জমির আবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। তারা আমার বাড়িতে এসে নানা সাহায্য সহযোগিতা পায় আর আমি বেকার হলাম। ঘরে খাবার জোটে না।
মিজানুর রহমান বলেন, বাড়ির সব জিনিস তালা দিয়ে রাখতে হয়। পাহারায় রাখতে হয়। সবসময় চুরি হয় বাড়িতে। কদিন আগে আমার বাড়ির ছাগল চুরি করে নিয়ে গেছে। ঈদে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ১ দিন বাড়িতে ছিলাম না। এসে দেখি আমার আলমারি ভেঙে প্রায় ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। অভিযোগ কাকে করব? এখানে রোহিঙ্গাদের শোনার লোক অনেক আছে। আমাদের কথা শোনার কেউ নাই।
স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি বলেন, আজ ২ বছর ধরে একটা আম মুখে দিতে পারিনি। আমার বাগানের আম খেয়ে প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকার বিক্রি করি। আমার আবাদের জমির ধান কাটার পরেই দেখি আইল নাই। সব ভেঙে ফেলছে। বিচার দেয়ার কেউ নাই।
তিনি আরো বলেন, ক্যাম্পের ভেতরের মানুষরা নিঃস্ব। সমস্যা বাড়ছে দিনকে-দিন। এভাবে চলতে থাকলে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা হতে পারে। দুর্ঘটনা এড়াতে চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরভাবে অন্যায় দমন করা ও স্থানীয়দের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে নানা রোগ। আমার এলাকায় অধিকাংশ লোক ভুগছেন শ্বাসকষ্টে। এ ছাড়া নানা ধরনের চর্মরোগ হয়।
সমস্যার শেষ নেই রোহিঙ্গাদেরও: আট ছেলে মেয়ে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন শমসের ইসলাম। তিনি ১৯৯২ সালেও একবার পালিয়ে এসেছিলেন। বছর খানেক থেকে আবার চলে যান। তার ২ স্ত্রী। একজন সন্তানসহ থেকে গেছেন সেখানে। তিনি প্রায় ৮ মাস ঝিনাইদহে ছিলেন। সেখানে কাজ করেছেন ইট ভাটায়, চালিয়েছেন অটো রিকশা। শমসের ক্যাম্পে ফেরত এসেছেন ২ মাস হলো।
তিনি বলেন, আমার ৮ ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকতে হয় ১ রুমে। অনেক সময় পালা করে ঘুমান তারা। এই ছোট রুমে এত মানুষ নিয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি। সাহায্য যথেষ্ট পাই। কিন্তু টাকার প্রয়োজন হয় অনেক সময়। তাই ক্যাম্প ছেড়ে যাই। কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের বি ব্লকের বাসিন্দা আজাদ মালয়েশিয়া থেকেও ঘুরে এসেছেন। সেখানে কাজ করেছেন ৬ মাস।
তিনি আরো বলেন, দালালের মাধ্যমে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গিয়েছিলাম? দালালকে দিতে হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে তার। কুতুপালং বাজারে থেকেই দালালরা করে দিয়েছেন পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা। তিনি মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছেন মিয়ানমার হয়ে। তার মিয়ানমারে যাতায়াত রয়েছে। তার দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী কুতুপালং বাজারের সেই দোকানে গিয়ে দেখা যায় ২ কক্ষ বিশিষ্ট দোকানটির সামনে মোবাইলের আর পিছনে কম্পিউটার ও প্রিন্টিং মেশিন এর ব্যবসা। পরিচয় গোপন করে জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে দিতে হবে বললে দোকানি রাজি হন। বলেন, দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু কিছু সময়পর সন্দেহ হওয়ায় দোকান ছেড়ে চলে যান তিনি।
উখিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক নুরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, কেউ যদি পালানোর চেষ্টা করে সে রাস্তা না ব্যবহার করে পাহাড় দিয়েই পালিয়ে যেতে পারবে। আর এই সড়কে এত গাড়ি প্রতিটি গাড়ি যদি ৫ মিনিট চেক করি তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট হয়ে যাবে। নির্দিষ্ট কোন সীমানা না থাকায় তারা ইচ্ছা করলেই পালাতে পারছে। এখন যে কাঁটা তারের বেড়া দেয়া হচ্ছে, আশা করি এতে ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার পথ বন্ধ হবে।