মুরতুজা হাসান : পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সবুজ বনায়নের জন্য দিনরাত কাজ করে যাওয়া এবং অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য জীবনের সকল দুঃখ সুখ ত্যাগ করে নিরলস পরিশ্রম করে থাকেন। এমনই এক প্রকৃতি প্রেমি বৃক্ষ পাগল মানুষের গল্প শুনাবো। নাম তার আলিমুজ্জামান টুটুল। পেশায় একজন বি,এস,সি ইঞ্জিনিয়ার। রয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের, (ভারপ্রাপ্ত) প্রধান প্রকৌশলী পদে।
মানুষ তার নিজ প্রয়োজনে চারদিকে বন জঙ্গল উজাড় করে দিচ্ছে, পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন যখন ধ্বংসের মুখে, অনাবৃষ্টি, ক্ষরা আর ঝড়-ঝঞ্ঝায় পৃথিবীর অস্তিত্ব যখন হুমকির মুখে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাজ।সারাবিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় তোলপাড় অথচ ২ যুগ আগে থেকেই ইঞ্জিনিয়ার টুটুল নিরবে নিভৃতে সম্পূর্ণ নিজ অর্থায়নে পরিচালনা করা যাচ্ছেন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। প্রচার বিমুখ এই মানুষটি গত ২৩ বছরে রোপন করেছন প্রায় ১০ লক্ষ গাছের চারা।
সারাদিন পরিশ্রম করে সবাই যখন বাড়ি ফিরে পরিবার পরিজন নিয়ে সময় কাটায় তখন এই মানুষটি নিজের আরাম আয়েশের কথা না ভেবে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বাড়ি তৈরীর নকশা করে যে অর্থ আয় করেন তার পুরোটাই ব্যয় করেন সমাজ বিনির্মানে মানুষের কল্যাণে সবুজ বনায়নে।
সময়টা ১৯৯৩ সাল হঠাৎ একদিন প্রকৌশলী টুটুল ভ্যান ভর্তি গাছ নিয়ে উপস্থিত হলেন তার গ্রামেরই এক স্কুলে। তিনি ছাত্র ছাত্রীদের বুঝালেন প্রতিনিয়ত পানির লেয়ার নিচে নেমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে বৃষ্টিপাত। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই পানি সংকটে পরবে জাতি,দেশ কিংবা গোটা পৃথিবী। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় বেশী বেশী বৃক্ষ রোপণ করা। তার কথায় দারুণ ভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন শিক্ষার্থীরা ফলে তিনিও পেলেন উৎসাহ। এরপর আর তিনি পিছন ফিরে তাকাননি। ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের নানা প্রান্তরে, লক্ষ তার একটাই বৃক্ষরোপণে মানুষকে উৎসাহিত করা। কখনো তাকে দেখা যায় ভ্যানে গাছ বোঝাই করে পিছু পিছু ছুটে চলেছেন অজানা কোনো পাড়া কিংবা মহল্লায়। কখনো বা কোনো এক মহল্লায় গিয়ে গরীব দুস্থ মহিলাদের মাঝে বিতরণ করেছেন ১০/১২ রকমের সবজির বীজ।
শুরুর দিকে প্রকৌশলী টুটুল প্রতি বছর তার নিজ গ্রাম হরিপুরে বিভিন্ন জাতের হাজার হাজার ফলের গাছের চারা কিনে জমা করতেন প্রতি শুক্রবার মাইকিং করে এসকল চারা বিতরণ করতেন। দূর দূরান্ত থেকে নানা বয়স শ্রেণী পেশার মানুষ আসতেন তার এ গাছের চারা নেয়ার জন্য।
২০০৫ সাল প্রকৌশলী টুটুলের হাত ধরে যাত্রা শুরু হলো গ্রীন চাইল্ড নামে একটি সংগঠনের। ২০ হাজার সদস্যের এ সংগঠনের মূল কাজ বৃক্ষ রোপণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করা। মজার বিষয় হলো এ সংগঠনের সদস্যরা সবাই স্কুল পড়ুয়া।
২০০৭ সাল ইঞ্জিনিয়ার টুটুল গড়ে তুললেন আরবান ইয়ুথ ক্লাব। এ সংগঠনের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তিন হাজার সদস্যদের সহায়তায় তিনি বিভিন্ন বড় বড় মেলায় অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন সময় দর্শনার্থীদের হাতে বিনামূল্যে তুলে দিয়েছেন হাজার হাজার গাছের চারা। যা তার কতশত নির্ঘুম রাতের কষ্টের ফসল।
২০০৬ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে ক্যাম্পাসের নানা অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শুরু করেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। এ পর্যন্ত তিনি তার নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ২০হাজার গাছ লাগিয়েছেন ১৭৫ একরের আঙ্গিনায়।
সম্প্রতি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ফলের বাগান, শেখ রাসেল হলে ফুলের বাগান, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ফল ও ফুলের বাগান এবং খালেদা জিয়া হলে ফুলের বাগান করণে তার সহযোগিতা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি প্রকৌশল ভবনের সামনের খালি জায়গা আর কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন রাস্তার দুপাশ দিয়ে রয়েছে অসংখ্য ফুল ও পাতা বাহারি গাছ শীত মৌসুমে যার সৌন্দর্যে দিগুণ হয়ে ওঠে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির এ ফুল বাগানগুলো। এ বাগানগুলো নিজস্ব অর্থায়নে করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আলিমুজ্জামান টুটুল।
আশার কথা হচ্ছে বৃক্ষ প্রেমী এ মানুষটি নিজে সবুজ বনায়ন আর বৃক্ষ রোপণ করে থেমে থাকেননি তিনি এ কাজে তার ছেলেকেও সম্পৃক্ত করেছেন। ২০১৫ সালের পর থেকে তার ছেলে তোফায়েল আহমেদ সাকিব প্রায় ৭০-৮০ হাজার গাছের চারা রোপন করেছেন বলে জানা যায়।
তিনি তার এ সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ডের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০১২ সালে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ সমাজ সেবকের পুরষ্কার ওঠে তার হাতে।
প্রকৌশলী টুটুল তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে বলেন, গাছ লাগানো আর নেশা এ ধারা অব্যাহত থাকবে পাশাপাশি আমি ভবিষ্যতে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সেজন্য ইতিমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছি।