কালের কন্ঠ : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় আরো ১০ জন ছাত্রের নাম এসেছে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে। কিন্তু তাদের অভিযোগপত্রে আসামিভুক্ত করা হয়নি। গত ১৩ নভেম্বর বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় এই মামলায়। ওই অভিযোগপত্রেই আরো ১০ জনের নাম পাঁচ আসামির স্বীকারোক্তিতে এসেছে বলে উল্লেখ আছে।
অন্যদের জবানবন্দিতে যে ১০ ছাত্রের নাম এসেছে তারা হলেন- বিটু, গালিব, সাইফুল, ইসমাইল, তাহসিন ইসলাম, আবু নওশাদ সাকিব, সাখাওয়াৎ ইকবাল অভি, শাহীন, আরাফাত ও প্রত্যয়। তারা বুয়েটের কোন বিভাগের ছাত্র বা কোন হলের কত নম্বর কক্ষে থাকেন, তা চার্জশিটে উল্লেখ নেই।
মহানগর গোয়েন্দা দক্ষিণ বিভাগের জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন, ঘটনার ধারাবাহিকতায় তাদের নাম আসামিরা জবানবন্দিতে উল্লেখ করলেও ঘটনাপ্রবাহে তাদের কোনো ধরনের ভূমিকা তদন্তে পরিলক্ষিত হয়নি। এমনকি তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সম্পৃক্ত বা সহায়তা করছেন বলেও সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো তথ্য-উপাত্তভিত্তিক প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি।
আবরার হত্যার পর এই মামলায় ২১ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ২১ আসামির মধ্যে ৮জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।৮জন হলেন ইফতি মোশাররফ হোসেন সকাল, বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, অনিক সরকার, মো. মুজাহিদুর রহমান, মনিরুজ্জামান মনির, এ এস এম নাজমুস সাদাত ও তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর।
তাদের মধ্যে সকাল, মেহেদী হাসান রবিন, নাজমুস সাদাত, মুজাহিদ ও জিয়ন ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণে প্রসঙ্গক্রমে ওই ১০ জন ছাত্রের নাম বলেছেন বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়। তবে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির এই অংশটুকু (তাদের সম্পর্কে যা বলা হয়েছে) চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়নি। আসামিরা স্বীকারোক্তিতে এই ১০ জন সম্পর্কে কী বলেছেন, তা-ও এ পর্যন্ত জানা যায়নি।
চার্জশিট থেকে দেখা গেছে, আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যেসব ছাত্রের নাম বলেছেন, তাদের মধ্যে সাখাওয়াৎ ইকবাল অভি, মোহাম্মদ গালিব, আবু নওশাদ সাকিব, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. ইসমাইল ও আবদুল মুবিন ইবনে হাফিজ ওরফে প্রত্যয়কে মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে। এই ৬জন সাক্ষী মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হতে পারেন।
চার্জশিটের আরো যা আছে;
৪ অক্টোবর ক্যান্টিনে পরামর্শসভা হয় : আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ৬ অক্টোবর রাতে। এর আগে ওই দিনই শেরেবাংলা হলের গেস্টরুমে মিটিং করে আবরারকে পেটানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু চার্জশিট থেকে জানা যায়, এর আগে ৪ অক্টোবর শেরেবাংলা আবাসিক হল ক্যান্টিনে আরেকটি মিটিং হয়। ওই মিটিংয়ে নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ও আরেক শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ মুন্না। আসামি অমিত সাহা, ইফতি মোশাররফ সকাল, আকাশ হোসেন, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়নসহ আরো কয়েকজন সেই মিটিংয়ে অংশ নেন। ওই মিটিংয়েই আবরারকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত হয়। সেখান থেকেই খোঁজ নেওয়া শুরু হয় আবরার তার কক্ষে আছেন কি না।
আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষেও নেওয়া হয় : ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। আবরার অসুস্থ হয়ে প্রস্রাব ও বমি করার পর ইশারা-ইঙ্গিতে তিনি প্রাণে বাঁচার মিনতি করেন। পরে তাকে বাথরুমে নিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এরপর তার জামাকাপড় বদল করা হয়। পরে মেহেদী হাসান রবিন ও ইফতি মোশাররফ সকালের নির্দেশে সাদাত, শামীম বিল্লাহ, রাফাত, আকাশ, মোয়াজ, জেমি ও তামিম ধরাধরি করে আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান। ওই কক্ষ থেকেই আবরারকে মুমূর্ষু অবস্থায় সকাল, মোয়াজ, মুজাহিদ, তানভীর ও তোহা একটি তোশকের মধ্যে পেঁচিয়ে দোতলা ও প্রথম তলার সিঁড়ির ল্যান্ডিং স্থানে রাখেন।
লাশ সরিয়ে নিতে চাপ সৃষ্টি : আবরার মারা গেলে তার লাশ নিচতলায় নামিয়ে আনা হয়। এ সময় চিকিৎসকও আসেন। চার্জশিটে বলা হয়েছে, আবরারের মৃতদেহ তড়িঘড়ি করে সরিয়ে নিতে চিকিৎসককে চাপ সৃষ্টি করেন আসামি বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। রাসেল এ সময় ঘটনাস্থলে থাকা অন্য ছাত্র ও হলের কর্মচারীদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলা যাবে না। চুপ থাকতে হবে।’
ঘটনার সময় ব্যবহৃত আলামত সরানো হয় : আবরার হত্যায় ব্যবহৃত ক্রিকেট স্টাম্প, স্কিপিং দড়ি, আবরারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, ল্যাপটপও সরিয়ে ফেলা হয়। মেহেদী হাসান রাসেলের নির্দেশে ওই সব আলামত আসামিরা ২০১০ নম্বর কক্ষে রেখে আসেন। ওই কক্ষে আসামি মোহতামিম ফুয়াদ থাকতেন। পরে হত্যা মামলা দায়েরের পর পুলিশ ২০১০ নম্বর কক্ষ থেকে আলামতগুলো উদ্ধার করে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিবির করার অপবাদ দেওয়া হয়েছিল আবরারের বিরুদ্ধে : আবরার শিবির করতেন, এটি ছিল নিছক অপবাদ। আবরার হত্যা মামলার চার্জশিটে বিষয়টি উঠে এসেছে। চার্জশিটে বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে একে অপরের সহায়তায় শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন। তার বিরুদ্ধে শিবির করার অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আপনার মতামত লিখুন :