শরীফা খাতুন , খুলনা : ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে খুলনার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রোববার ভোরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানে। একটানা কয়েক ঘণ্টার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বিস্তির্ণ এলাকা। মুহুর্তেই ভেঙে পড়ে কয়েক হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি, অসংখ্য গাছ-গাছালি। এছাড়া হাজার হাজার হেক্টর ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে। এছাড়া ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’র আঘাতে খুলনার ৯টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব উপজেলায় আনুমানিক ২লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রায় দুই ৪৭ হাজার ২৭৫ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আংশিক ৩৭৮২০ এবং সম্পূর্ণ ৯৪৫৫ টি।
বুলবুলের তান্ডবে পাইকগাছা কপিলমুনির হবিনগর মোড়ের সামনে টাওয়ারের পাশে বিদ্যুতের তারের উপর গাছ পড়ে তৈরি হয়েছে মৃত্যুফাঁদ, নিচে আটকে গেছে ঢাকা থেকে আসা পাইকগাছা গামী পরিবহন, যে কোনো মুহুর্তে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা, যানবাহন চলাচল করতে পারছে না।
অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে রোববার খুলনায় গাছচাপা পড়ে নারীসহ দুই জনের মৃত্যু হয়েছে।
নিহত দুইজন হলেন- খুলনার দাকোপ উপজেলার দক্ষিণ দাকোপ গ্রামের সুভাষ মণ্ডলের স্ত্রী প্রমিলা মণ্ডল (৫২) ও খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামের আলমগীর হোসেন (৩৫)।
খুলনার দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল ওয়াদুদ জানান, শনিবার (৯ নভেম্বর) রাতে প্রমীলা দক্ষিণ দাকোপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টারে ছিলেন। সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টার দিকে নিজের বাড়িতে যান তিনি। সেসময় একটি গাছ তার উপরে পড়লে প্রাণ হারান প্রমীলা।
দিঘলিয়া থানার ওসি মঞ্জু মোর্শেদ জানান, দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামে সকাল ৯টার দিকে বাসার পাশে অবস্থান করছিলেন আলমগীর হোসেন। এসময় একটি সজনে গাছ ভেঙে তার উপরে পড়লে আহত হোন তিনি। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে খুলনা জেলায় ২৫ হাজার ৮৬৪ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন ধান, পান ও শীতকালীন সবজির।
দূর্যোগের শিকার স্থানীয়রা বলছেন, মানুষ এবং গবাদি পশুর পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে ক্ষেতের ফসল। পানিতে ডুবে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরে এরকম ক্ষতির মুখোমুখি হইনি।
চাষীরা জানান, পানিতে ডুবে আছে কাঁচা-পাকা আমন ধানের ক্ষেত। পানি তাড়াতাড়ি নেমে গেলে হয়তো ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা যাবে। সেই সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে কলার বাগান আর সবজি ক্ষেতও।
দাকোপের কৃষক রাসেল জানান, ধান গাছ তো ডুবেই গেছে, কলার বাগান, পেঁপের ক্ষেত, সবজি বাগান সব বাতাসে হেলে পড়ে, পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে।
বাজুয়ার চাষী শীলা দিত্য বলেন, প্রবল বৃষ্টি ও ঝড়ে বিভিন্ন সবজি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কোথাও আবার কাদামাটির সঙ্গে লেপ্টে আছে। কাঁচা পাকা ধান পানিতে ডুবে গেছে।
ডুমুরিয়ার কৃষক হালিম জানান, কয়েক দিন আগেও যে সবুজ শ্যামল ফসলি জমির মাঠ ভরা ছিল, আজ আর নেই। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে বৃষ্টিতে ডুবে তা নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষেতের ফসল হারিয়ে ঋণের বোঝায় নি:স্ব হয়ে যাবেন অনেক কৃষক।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রূপসা উপজেলার পান চাষীদের। চাষীরা বলেন, বছরভর পান চাষীরা এই শীত মৌসুমের অপেক্ষায় চেয়ে থাকে। কারণ শীতকালে পানের দাম বৃদ্ধি পায়। সারা বছরের শেষে এখন বরজের সব পান এক সঙ্গে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা পাবে এমন সময়ের পূর্ব মুহূর্তে ঝড়ে পানের বরজ ভঙ্গে পড়েছে। অতি বৃষ্টিতে পচন ধরেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপ-পরিচালক পংকজ কান্তি মজুমদার বলেন, খুলনা জেলায় ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে ধান ও ৮৬৪ হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাকসবজির ক্ষতি হয়েছে।
এর মধ্যে ধানে ক্ষতি হয়েছে কয়রা, ডুমুরিয়া, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটায়। জেলার প্রায় সব উপজেলায় সবজিতে ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ডুমুরিয়ায়। এছাড়া কলা, পান ও পেঁপেতেও ক্ষতি হয়েছে। মাঠে কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।সম্পাদনা:জেরিন মাশফিক
আপনার মতামত লিখুন :