তন্নীমা আক্তার : বাংলাদেশে বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাষ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি বাণিজ্যিক একোয়াকালচার পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দুই প্রজাতির চিংড়ির মধ্যে বাগদা চিংড়ির অবদান প্রায় ৭০ শতাংশ এবং এর চাষ পদ্ধতি উপকূলীয় লোনা পানির বিস্তীর্ণ এলাকার ২,২০,০০০ হেক্টর জমিতে বিস্তৃত। দেশে বর্তমানে ২ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৪ হেক্টর ঘেরে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এই চিংড়ি ও মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে সারা দেশে গড়ে উঠেছে ১১০টি কারখানা। বার্ষিক সাড়ে ৩ লাখ টন উৎপাদন সক্ষমতা থাকা এসব কারখানা থেকে হিমায়িত মৎস্য ৬০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশীয় জাতের বাগদা, গলদা, হরিণা ও চাগা চিংড়ির চাহিদা যেন ক্রমেই কমছে বিশ্ববাজারে। তার পরিবর্তে বাড়ছে চিংড়ির আরেক জাত ভেনামির চাহিদা।
বিশেষ করে দামে সস্তা আর কম খরচে অল্প জমিতে অধিক পরিমাণের উৎপাদনই ভেনামির এত চাহিদার কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে নানা কারণে এ চিংড়ির চাষ এখনো শুরু হয়নি বাংলাদেশে। এ ছাড়াও চিংড়ি চাষে কাঁচামাল সংকটের কারণেও সংকটের মধ্যে আছেন রপ্তানিকারকরা। তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি চাষের কাঁচামাল সংকটের কারণে দেশের ১১০টি কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে ৮০ শতাংশ।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫৫ কোটি মার্কিন ডলারের প্রায় ৪৭ হাজার ৬৩৫ টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৫১ কোটি মার্কিন ডলারের ৪৪ হাজার ২৭৮ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রপ্তানি আরও কমে হয় ৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলারের ৪০ হাজার ৭২৬ টন।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের ৩৯ হাজার ৭০৬ টন চিংড়ি। ২০১৭-১৮তে রপ্তানি হয় প্রায় ৪১ কোটি ডলারের ৩৬ হাজারের ১৬৮ টন এবং সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি করা হয়েছে ৩৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের ৩৩ হাজার ৩৬৩ টন হিমায়িত চিংড়ি। অর্থাৎ গত ছয় অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে ১৪ হাজার ২৭২ টন এবং রপ্তানি মূল্য কমেছে প্রায় ১৯ কোটি মার্কিন ডলার।
কিন্তু গত কয়েক বছর এসব হ্যাচারি ও ঘেরে চিংড়ির উৎপাদন কমে গেছে। যার মূল কারণ হিসেবে বিদেশি অর্ডার কমে যাওয়াকেই দায়ী করেছেন হ্যাচারি ও ঘের মালিকরা। ২০১৭ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের মোট চিংড়ি উৎপাদনের ৭৭ শতাংশই ছিল ভ্যানামি। সেখানে বাগদা ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, গলদা উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ।
চিংড়ি চাষিরা জানান, সাধারণত বাগদা চিংড়ি হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয় সাড়ে ৩০০-৪০০ কেজি। সেখানে ভ্যানামি চিংড়ির উৎপাদন ৮-১০ হাজার কেজি। অন্যদিকে বিদেশের বাজারে ভ্যানামি চিংড়ির দাম কেজিপ্রতি ৪-৫ ডলার হলেও বাগদা চিংড়ি বিক্রি হয় ১৫-২২ ডলারে। ফলে সুস্বাদু হলেও দামের কারণে বাগদাসহ অন্যান্য চিংড়ির চাহিদা কমছে বহির্বিশ্বে। সুতরাং বিশ্ববাজার ধরতে হলে দেশে ভ্যানামি চিংড়ি উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।
জানা গেছে, দেশীয় চিংড়ি রক্ষায় সরকারের কাছে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) কিছু সুপারিশ দিয়েছে। সেগুলো হলো বর্তমানে সরকার চিংড়ি চাষে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এই প্রণোদনা বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করতে হবে। হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনায় যে ১০ শতাংশ আয়কর কর্তন দেওয়া হয়েছিল সেটা বন্ধ করতে হবে। সরকার যে সাদা জাতের চিংড়ি রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল প্রত্যাহার করতে হবে সেটা। খুলনা অঞ্চলে দুটি এবং চট্টগ্রামে একটি ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার স্থাপন করতে হবে। যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা চিংড়ি মাছের ভেতরে অপদ্রব্য পুশ কিংবা মাথা কাটতে না পারে।
আপনার মতামত লিখুন :