শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৫ নভেম্বর, ২০১৯, ০৫:৫৭ সকাল
আপডেট : ০৫ নভেম্বর, ২০১৯, ০৫:৫৭ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ছাত্রলীগ: আশার পালাবদলে হতাশ নেতাকর্মীরা

ডেস্ক রিপোর্ট : ছাত্রলীগের ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছিল গত ১৪ সেপ্টেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের প্রথম বলি হন সংগঠনটির শীষ দুই নেতা। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অপসারণের পর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেন দুজনকে। চাপের মুখে থাকা ছাত্রলীগে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও আসে। তবে সংগঠনটির বিক্ষুব্ধ একটি অংশ দাবি করছেন, তারা পূর্বের দুই নেতার ফরমায়েশ বাস্তবায়নেই ব্যস্ত রয়েছেন। দায়িত্বে আসার দেড় মাসেও বিতর্কিতদের সংগঠন থেকে বিতাড়িত করতে না পারাকে বড় ধরণের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তারা। জানা গেছে, ভিতরে ভিতরে আন্দোলনে নামারও প্রস্তুতি চলছি। ফলে যে কোন সময় ছাত্রলীগের ঘরের দ্বন্দ্ব ফের প্রকাশ্যে আসতে পারে। তবে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ জানার্ল

ঘটনা যেভাবে শুরু

গত বছরের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সম্মেলনের আড়াই মাস পর গত বছরের ৩১ জুলাই পরবর্তী দুই বছরের জন্য রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়।

১০ মাসের মাথায় গত ৩১ মে ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট নতুন কমিটির ঘোষণা দিলে পদবঞ্চিতরা মধুর ক্যান্টিনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে শোভন-রাব্বানী অনুসারীদের মারধরের শিকার হন। মাদকাসক্ত, বিবাহিত, বহিষ্কৃত, মামলার আসামি, বয়সোত্তীর্ণ, চাকরিসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এমন শতাধিক ব্যক্তিকে পদে রাখার প্রতিবাদে পদবঞ্চিতরা ২৮ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান করেন।

অভ্যন্তরীণ অসন্তোষে টালমাটাল অবস্থার পর আরো বেশ কিছু অভিযোগ ও বিতর্কের মুখে প্রায় ১১ মাস বাকি থাকতেই শোভন-রাব্বানীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন সংগঠনটির আদর্শিক নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের ৭১ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বিশেষ করে ‘চাঁদাবাজির জন্য’ সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের এমন পরিণতি হয়। ছাত্রলীগ থেকে সভাপতির পদ খোয়ানোর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট থেকেও (সদস্য পদ) ইস্তফা দেন রেজওয়ানুল হক শোভন। তবে প্রচুর সমালোচনা সত্ত্বেও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকের (জিএস) পদ থেকে পদত্যাগ করেননি গোলাম রাব্বানী।

সম্মেলনের প্রস্তুতি কতদূর?

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে শোভন-রাব্বানীকে বাদ দেওয়ার পর আল নাহিয়ান খান জয় এবং লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদ মাধ্যমে বলেছিলেন, তারা (ভারপ্রাপ্ত কমিটি) ছাত্রলীগের সম্মেলনের প্রস্তুতি নেবেন।

ছাত্রলীগের বিক্ষুব্ধ অংশটিও মনে করে সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক রাকিব হোসেন এ বিষয়ে বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার পথকে মসৃণ করার জন্য ছাত্রলীগে সম্মেলনের কোন বিকল্প নাই। নতুন সম্মেলনের মাধ্যমে বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং কাঠামো ভেঙে গেছে সেটা উদ্ধার করা সম্ভব। তাই যত দ্রুত সম্মেলন হবে তা এই সংগঠনের জন্য মঙ্গল। ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। এটি এরকম বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকতে পারে না। বিতর্কমুক্ত ছাত্রলীগ করতে তারা টোটালি ব্যর্থ হয়েছে। তারা শোভন-রাব্বানীর অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়নে ব্যস্ত রয়েছে। যাদেরকে আপা বহিষ্কার করেছে তাদের বাইরে তারা (জয়-লেখক) যেতে পারে নাই।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর বিষয়ক উপ-সম্পাদক শেখ নকিবুল ইসলাম সুমন বলেন, ছাত্রলীগের যে কাঠামো- চেইন অব কমান্ড তা কোথাও নাই। চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা দ্রুত সম্মেলন চাই। সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব, তাদের যদি বয়স থাকে তারাও যদি আসে সেটা সম্মেলনের মাধ্যমে আসলে ছাত্রলীগ আরো শক্তিশালী হবে। শক্তিশালী হলেই ছাত্রলীগের ইমেজ (ভাবমূর্তি) ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

কমিটি থেকে বিতর্কিতদের অপসারণ

পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলেন ছাত্রলীগের বড় একটি অংশ। বিবাহিত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, চাকরিজীবী ও বিভিন্ন মামলার আসামিসহ নানা অভিযোগে যুক্ত অনেককে পদ দেওয়া নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাপের মুখে বিতর্কিতদের পদ থেকে বাদ দেওয়ার কথা ওঠে। শোভন-রাব্বানীর অপসারণের পর তাই পদবঞ্চিতরা উচ্ছ্বাস করেছিলেন। আশা ছিল বিতর্কিতদের পদ থেকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিবেন জয়-লেখক। তবে এক মাস ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও সেই আশার বাতি এখনো জ্বলেনি।

ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু  বলেন, বিতর্কমুক্ত তো হয়ই নি বরং এটা নিয়ে হেলা ফেলা করা হচ্ছে। আগের যারা ছিল তারা যে রকমভাবে এ বিষয়ে হেলাফেলা করেছে তারাও (জয়-লেখক) সেইম (একই রকম) করছে।

ছাত্রলীগের সাবেক অপর এক নেতা বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পরে মিডিয়াতে তারা (জয়-লেখক) বলেছিল, ছাত্রলীগকে বিতর্কমুক্ত করবে। তারা তাদের প্রথম কথা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।

ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর বিষয়ক উপ-সম্পাদক শেখ নকিবুল ইসলাম সুমন  বলেন, ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বে আসার পর তারা আমাদের কাছে সময় চেয়েছে। তারা বলেছিল- আমরা বিতর্কিতদের কমিটি থেকে বাদ দেব। দেড় মাসের বেশি হয়ে যাচ্ছে তারা কোন স্টেপ নিচ্ছে না। যারা বিতর্কিত আছে তাদেরকে নিয়ে তারা চলাফেরা করতেছে, বিভিন্ন মিছিল-মিটিং-প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছে। জেল হত্যা দিবসেও বিতর্কিতদের নিয়ে ফুল দিয়েছে। বিতর্কিতদের তারা আশ্রয় দিচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।

সারাদেশে সাংগঠনিক সফর ও কমিটি গঠন কত দূর?

ছাত্রলীগে শৃঙ্খলা ফেরাতে সারাদেশে সাংগঠনিক সফর করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তবে এখনো সেই সফর শুরু করা যায়নি বলে জানা গেছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে সারাদেশে কমিটি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ সারাদেশের কমিটি প্রধানরাই সম্মেলনে কাউন্সিলর হিসেবে ভোট দিয়ে নতুন নেতা নির্বাচনে অংশ নেন। ফলে সম্মেলনের আগে জেলা কমিটি গঠন করাকে সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু গত দেড় মাসে মাত্র একটি জেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

কি পরবির্তন?

এ দুই শীর্ষ পদে আসা মাত্র বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে যাওয়া এবং বিশাল প্রটোকল নিয়ে চলাফেরার অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের। তবে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আসার পর এ ক্ষেত্রে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছেন জয়-লেখক। হলে থাকা, প্রোটোকল ছাড়া চলাফেরাসহ অপকর্ম করা মাত্র বহিষ্কার করার মত বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন তারা এনেছেন। ছাত্রলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বুঝতে পেরে সংগঠনটির নেতারা এখন বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন।

শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা ছাত্রলীগ নেতা সাইফ বাবু এই প্রসঙ্গে বলেন, একটা শক্তি ফিরে এসেছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে একটা আতঙ্ক ছিল। সব জায়গায় দুর্নীতি, টাকা-পয়সার যে একটা লেনদেন- এ জায়গায় সারাদেশের কর্মীরা অন্তত স্বস্তির সাথে নিঃশ্বাস ফেলতে পারতেছে। তাদের কাছে আগের মত কেউ বলে না- ‘ওমুক জায়গায় কাজ আছে। তুমি আর আমি মিলে করি। তুমি এত ভাগ নাও, আমি এত ভাগ নেই।’ এগুলো এখন হচ্ছে না।

কি বলছেন জয়-লেখক?

পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য  বলেন, ছাত্রলীগের ইতিহাসে আগে এ রকম ঘটনা ঘটেনি। ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছিল, যেসব ব্যাপারে সাধারণ মানুষের এবং ছাত্রদের অভিযোগ ছিল সেগুলো আমরা ওভারকাম করেছি। ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার পরে লাইফস্টাইল রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যেত, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আমরা সেটা করি নাই, আমরা সাধারণ ছাত্রদের সাথে হলে থাকি এবং কোন ধরণের প্রটোকল নেই না। -এগুলো ভাবমূর্তি কেন্দ্রীক কাজ।

তিনি বলেন, সাংগঠনিক কার্যক্রমের ভিতরে আমরা আসার পরে বিভিন্ন অভিযোগ ছিল। জায়গা থেকে অভিযোগ আসত- অনুপ্রবেশসহ বিভিন্ন ধরণের যে অভিযোগ আসত তা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করেছি বা বহিষ্কার করেছি। একটা জেলা কমিটি দিলাম- নড়াইলে। কমিটি দিতে হলে একটা পরিবেশ তৈরি করে দিতে হয়। আমরা সেই পরিবেশ তৈরির কাজ করছি।

সারাদেশে সাংগঠনিক সফর প্রসঙ্গে বলেন, এখনো শুরু করিনি। সফর শুরু করার আগে তো আমাদের কিছু কার্যক্রম আছে। এক জেলায় গেলে আরেক জেলায় ফাঁকা থাকলে তো হবে না। সব জেলায় নূন্যতম একটা পরিবেশ তো তৈরি করতে হবে। সেই পরিবেশ তৈরির কাজই আমরা করছি। আমরা সবার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করছি। শীগগিরই আমরা সারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিকে নিয়ে একটা বর্ধিত সভা ডাকব।

বিতর্কিতদের বাদ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যারা বিতর্কিত আছে- তাদের বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। সেটা নিয়েও কাজ চলছে। এটা করার পরে বর্ধিত সভা ডেকে আমরা সফর শুরু করব। বিতর্কিতদের বিষয়ে অভিযোগ এসেছে অনেক। পদবঞ্চিতরা দিয়েছিল ১০০ জনের মত আরো বিভিন্ন জন দিয়েছে এবং (এগুলোর) বেশির ভাগই হচ্ছে বানোয়াট, মিথ্যা অভিযোগ। এ জন্য আমরা যাচাই-বাছাই করছি। যেগুলো অ্যাকচুয়াল অভিযুক্ত যারা আছে, সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

কেন্দ্রীয় সম্মেলন কবে হতে পারে?

চার বছর পরে সম্মেলন হওয়ারও কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আগাম সম্মেলন হওয়ার কোন সম্ভাবণা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সাংগঠনিক নিয়মে দু’বছর পর পর সম্মেলন হওয়ার কথা। সেই সম্মেলনটা আগাম হবে নাকি আরো পরে হবে এই সিদ্ধান্ত আমাদের একমাত্র অভিভাবক জননেত্রী শেখ হাসিনার। তিনি শুধু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আর কারো নেই।

কোন দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখাতে পারেননি- এমন অভিযোগের বিষয়ে বলেন, গুটি কয়েক এ কথা বলেন। তারা যতদিন না পর্যন্ত ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি হতে পারবে ততদিন পর্যন্ত তাদের সমস্যার সমাধান হবে না। তারা যেটা চিন্তা করে- রাতারাতি সবকিছু পরিবর্তন করা সম্ভব। এটা আসলে করা সম্ভব না। পাঁচ-সাতজন ছাড়া আর সবাই জানে ব্যাপারটা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়