ফরিদ কবির : ১. ছেলেবেলায় আমার কোনো গৃহশিক্ষক ছিলো না। আমার মা-বাবার সাধ্য ছিলো না, তারা আমার জন্য একজন গৃহশিক্ষক রাখেন। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। একদিন একটা অঙ্ক কিছুতেই করতে পারছিলাম না। শেষে বাধ্য হয়ে আমার এক মামার বাসায় চলে গেলাম। আমার দুই মামাতো ভাইকে যে গৃহশিক্ষক পড়াতেন, তার সামনে গিয়ে বললাম, স্যার, এ অঙ্কটা কিছুতেই পারছি না। যদি একটু বুঝিয়ে দিতেন। তিনি খুবই আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে দিলেন। আমি যখন ফিরে আসছিলাম, তিনি বললেন, তুমিও এখানে আমার কাছে পড়তে পারো। আমি বললাম, আমার বাবা-মা তো টাকা দিতে পারবেন না। তিনি বললেন, তোমার বাবা-মাকে কিছু দিতে হবে না। তুমি প্রতিদিন এসে আমার কাছে পড়বে, কেমন? আমি বললাম, আচ্ছা। মাত্র একমাসই তার কাছে আমি পড়তে পেরেছিলাম। এই একমাসেই তিনি আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন। খুবই স্নেহ করতেন আমাকে। আমার মামাতো ভাইদের বলতেন, দেখো, ফরিদ অনেক দূর যাবে। কিন্তু হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। স্যারকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। স্বাধীনতার পরও স্যারের কোনো হদিস পাওয়া গেলো না। আমার মামাতো ভাইদের জন্য নতুন গৃহশিক্ষক রাখা হলো। কোনোভাবে আমাদের কানে এলো, সেই গৃহশিক্ষক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ। হয়তো যুদ্ধে মারা গেছেন। আমি অন্তত তেমনই জেনেছিলাম।
১৯৭৯ সাল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। তখন আমরা বিসিসি রোডে থাকতাম। গুলিস্তান থেকে বাসে শাহবাগ যেতাম। সেখান থেকে হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। একদিন বাসে উঠেছি। গুলিস্তান ছেড়ে বাস প্রেসক্লাবের কাছে যেতেই বাস কন্ডাক্টর আমার কাছে এলেন। হাত বাড়িয়ে বললেন, ভাড়া? আমি পকেট থেকে একটা আধুলি তার দিকে ধরতেই চমকে গেলাম। তিনি তো আমার স্যার। যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার, আমি ফরিদ। জিন্দাবাহারে থাকতাম। তিনি আমার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি ফরিদ? আমি বললাম, জি স্যার। আমি ফরিদ। স্যার আমার আধুলিটা ফেরত দিয়ে বললেন, এটা রেখে দাও। বলেই তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটা শাহবাগ এসে পড়লে আমি বাস থেকে নেমে গেলাম। বাসটা এলিফ্যান্ট রোডের দিকে এগিয়ে গেলে আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। হায় হায়! তার ঠিকানা তো নেয়া হলো না। এর পর বহুদিন আমি তাকে খুঁজেছি। সব বাসে। তাকে আর আমি খুঁজে পাইনি। আজও না। হয়তো কখনোই তাকে আর খুঁজে পাবো না। তাকে পেলে শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করতাম, তার কেন মনে হতো, আমি অনেক দূর যাবো? আসলেই কি আমি অনেক দূরে যেতে পেরেছি? দূরে যাওয়া আসলে কি? কতোটা গেলে আমরা বুঝবো, আমরা অনেক দূরে গেছি। কিছু প্রশ্নের জবাব হয়তো কখনো জানা হয় না।
২. আবরারকে পিটিয়ে মারার একটা ভিডিওর কয়েক সেকেন্ড আমি দেখেছি। তার গগনবিদারী চিৎকার শুনে আমার চোখে পানি এসে গেছে। দেড় মিনিটের সেই ভিডিওটা আর আমার দেখা হয়নি। কে কে পুরো ভিডিওটি দেখেছেন, আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে। আমার প্রশ্ন একটাই, আপনারা কীভাবে এমন নির্মম ও মর্মান্তিক ভিডিওটা দেখতে পারলেন? কয়েক সেকেন্ড দেখার পর মনে হচ্ছিলো, হকি স্টিকের বাড়িগুলো আমার শরীরে এসে পড়ছে। অসহ্য সেই ব্যথা। অসহ্য। এখনো যেন অবিরাম আমারই পিঠে হকিস্টিকের বাড়ি চলছে। আমি নির্মম ব্যথায় আর্তনাদ করে চলেছি। ৩. আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাই বড় সমস্যা। এটাকে ঢেলে সাজানো দরকার। শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা দরকার। দলীয় রাজনীতি যারা করেন, তারা শিক্ষক হবার যোগ্য নন। যোগ্য যে নন, তা তো বুয়েটের উপাচার্যই প্রমাণ করেছেন। ছাত্র রাজনীতিও বহাল থাকবে কিনা তাও ভেবে দেখা দরকার। ৪. সমস্যাটা কেবল ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের নয়। সমস্যাটা আমাদের মানসিকতারও। আমার অফিসে আমি যদি বসের মতের বিরোধিতা করি, তিনি পরেরদিনই আমাকে টারমিনেট করে দেবেন। এটাই স্বাভাবিক। মতের বিরুদ্ধে গিয়েছিলাম বলে ব্যাংকের চাকরি থেকে আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছিলো। ভোরের কাগজে থাকতে সম্পাদকের মতের বিরুদ্ধে গিয়েছিলাম বলে তিনি আমাকে সম্পাদকীয় বিভাগ থেকে বদলি করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমাকে নিযুক্ত করেছিলেন আমার জুনিয়রের অধীনে। ইস্তফা দেয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। তারা সমাজের বিদগ্ধজন। তারাই যদি ভিন্নমত সহ্য করতে না পারেন, অন্যরা তা পারবে কেন? তারা বয়সে কম হলে, ক্ষমতাবান হলে, হয়তো ভিন্নমতের কারণে আমাকে এভাবেই পিটিয়ে মেরে ফেলতেন। প্রিয় বন্ধুরা, আপনারাই বলেন, আপনি আপনার সমালোচনা পছন্দ করেন? সহ্য করেন?
আমি জানি, নব্বই শতাংশই ভিন্নমত বা সমালোচনা পছন্দ করেন না। সমালোচনা করলেই আপনি তাদের ব্লক করে দেন। দেন না? যারা এমন আচরণ করেন, তারা প্রত্যেকেই মনের মধ্যে আসলে একজন খুনিকেই পোষেন। খুন করতে না পারলেও সাধ্যে যতোটুকু কুলোয় তাই করেন। এই মনস্তত্ত্ব আমাদের মধ্যে জেঁকে বসে আছে। আমরা বড় হয়ে উঠছি, বেড়ে উঠছি যতোটা না ভালোবাসা নিয়ে, তার চাইতে বেশি ঘৃণা নিয়ে। এই ঘৃণা দূর না হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। ৪. সমস্যার মূলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও। আমাদের শিক্ষা এখন হয়ে উঠেছে ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক। এখন সবাই ডাক্তার হতে চায়, ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, কর্মকর্তা হতে চায়। কেউ শিক্ষিত হতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কেবল শেখার জন্য আর যায় না। এখন তাই বিবিএ, এমবিএ, এমবিবিএস ডিগ্রিই বেশি মূল্যবান। ক’জন বাবা-মা আছেন যারা চান, তাদের ছেলেমেয়ে সাহিত্য পড়ুক? ভাষা নিয়ে পড়ুক? কিংবা কেবলই একজন ভালো মানুষ হয়ে বের হোক? কেবলই একজন মানবিক মানুষ? কেউ চান? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো কে চান?
৫. মানুষের পক্ষে সব কিছুই হওয়া সম্ভব। কেবল মানুষ হতে পারাই সবচাইতে কঠিন। ঘৃণা করাও খুব সহজ। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসতে পারা খুবই কঠিন। এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে সহ্য করতে পারে না। আস্তিকরা নাস্তিকদের সহ্য করতে পারে না। নাস্তিকরা আস্তিকদের। ধনীরা গরিবদের। গরিবরা ধনীদের। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে। বিএনপি আওয়ামী লীগকে। ভাই রে, কেউ আমার মত না মানলে না মানবে। কেউ বেশি অসহ্য হলে তাকে এড়িয়ে চললেই তো হয়। তাকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিতে হবে? যে কারণে আপনি একজনকে সরিয়ে দেবেন, জানবেন একই কারণে আরেকজন আপনাকেও একদিন সরিয়ে দিতে পারে। ধরে নিন, এখন দিন। আপনিও তাই জানেন। কিন্তু আমি বলবো, এখন রাত। আমার খুশি আমি এমনটাই বলতে চাই। তাই বলে আমার খুশিকে আপনি পা দিয়ে মাড়াতে পারেন না। আর যদি আমার মতের স্বপক্ষে সামান্য যুক্তিও থাকে তবে তা মেনে নিতে সমস্যা কী? আপনি যে আমার মতের নন, আমি কি তা মেনে নিচ্ছি না? ৬. আমাদের মিডিয়াও সেই মিডিয়া আর নেই। আমাদের দেশে নানা অপরাধ ঘটে চলেছে। কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন মিডিয়ায় নেই। কোনো একটা অপরাধ সামনে এলেই শুধু মিডিয়া তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিহত আবরারের বাবা-মায়ের বক্তব্য নিতে তারা যতো আগ্রহী, অপরাধীদের বাবা-মায়ের বক্তব্য নিতে তারা ততোটাই অনাগ্রহী। তাদের তো প্রশ্ন করা উচিত, অপরাধীদের বাবা-মাকে। তাদের প্রতিক্রিয়া কি? তারা কি এমন অপরাধী সন্তানই জন্ম দিতে চেয়েছিলেন? তাদের ভাবনা কি? আবরারকে যারা পিটিয়ে মারলো, তাদের বাবা-মায়ের বক্তব্য কি? ৭. শুরুতে এক মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকের গল্প আমি বলেছি। এই দেশ তাকে কোনো মর্যাদা দেয়নি। একটা সম্মানজনক চাকরি যে তিনি পাননি, তা আজ বুঝতে পারি। অথচ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই, এমন লোকেরা শিক্ষকদের নেতা হয়ে বসে আছেন। ৮. শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে এমন শিক্ষক আমাদের দেশে এখন কজন আছেন? জানতে ভারি ইচ্ছে করে। তা যদি না থাকে, তবে আমরা কার কাছ থেকে শিখবো? কি শিখবো? অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে আমাদের। স্কুল আছে, কলেজ আছে, বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কিন্তু মানুষ হওয়ার শিক্ষারই অভাব সেখানে। তাহলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার দরকার কি? ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :