শিরোনাম
◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো

প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ০১:০৩ রাত
আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ০১:০৩ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মানবকল্যাণে প্রস্তাবিত মানব দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান প্রসঙ্গে খসড়া আইনটিতে আলেমগণের পরামর্শ গ্রহণ করা প্রয়োজন

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : মানুষ সৃষ্টি করে আল্লাহ তাআলা তাকে যে আয়ু দান করেছেন, সে পরিমাণ সময়ে সুস্থ্ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা, প্রয়োজনীয় কর্ম করা এবং জীবন পরিচালনার জন্য যথাযথ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করেছেন। বাহ্য অঙ্গগুলোর মধ্যে প্রধান হলো- মস্তক, হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। অন্তেন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- হৃদপিণ্ড, যকৃত, ফুসফুস, কিডনী, বাল্ব, অস্থি, মজ্জা, অগ্নাশয়, অন্ত্রনালী, টিস্যু ও রক্ত ইত্যাদি। এসবের মধ্যে শুধু রক্তই পরিবর্তনীয় ও পুরণীয়; অন্যগুলো অপরিবর্তনীয় ও অপুরণীয়। তাই ফকীহ উলামায়ে কিরাম সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, মুমূর্ষ রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য জরুরী অবস্থায় রক্ত দান করা যাবে, যেহেতু এটি পুরণীয়; কিন্তু কোন অবস্থাতেই তা বিক্রয় করা যাবে না, কারণ মানুষ এর মালিক নয়; আর মানব দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেহেতু পূরণীয় নয়, সুতরাং সেগুলো দান করাও যাবে না।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনন্য সৃষ্টি এ মানবযন্ত্র সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য যা যা প্রয়োজন, সেসব আয়োজন করে প্রকৃতিতে ও পরিবেশে অনুকুল তাপমাত্রা, জলবায়ু বা আবহাওয়া এবং উপযুক্ত খাদ্য ও পুষ্টির যোগান তিনিই দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু মানুষ আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে প্রকৃতির নিয়ম অমান্য করে, পরিবেশের ক্ষতি করে, খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণে অনিয়ম করে; অখাদ্য কুখাদ্য বা অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করে, অকর্মণ্যতা ও অলসতা, অযত্ন ও অবহেলার মাধ্যমে দেহরূপ যন্ত্রকে অচল বা বিকল করে ফেলে।যার ফলে দেখা দেয় রোগ-শোক, জ্বরা-ব্যধি, অঙ্গহানি বা বিকলাঙ্গতা এবং শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতা। এগুলোর মধ্যে চোখের সমস্যা, হার্টের সমস্যা, কিডনীর সমস্যা, যকৃতের সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা ও অগ্নাশয়ের সমস্যা প্রধান। এক সময় এগুলো ছিল দূরারোগ্য ব্যধি। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এসব সমস্যার সমাধানের প্রয়াস চালাচ্ছে। প্রথমত, এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো নির্মাণ বা তৈরীকরণ; দ্বিতীয়ত সুস্থ কোন ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যত্তির অঙ্গে প্রতিস্থাপন। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি বর্তমানে খুবই প্রচলিত।

অধুনা বাংলাদেশে ওপেন হার্ট সার্জারীসহ কিডনী প্রতিস্থাপন ও চোখের কর্ণিয়া সংযোজন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ‘মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ নামে একটি আইনও প্রণয়ন করেছে। এ আইনের আওতায় জীবিত ব্যক্তিরা কিডনী ও যকৃত প্রতিস্থাপনের জন্য দান করতে পারেন। এছাড়া চক্ষু (কর্ণিয়া) দানেরও সুযোগ রয়েছে। তবে সংযোজনের জন্য অন্য কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করা এখনো শুরু হয়নি। এ আইনটি বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও নানান জটিলতার কারণে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই বাংলাদেশের শীর্ষ কিডনী বিশেষজ্ঞরা এ আইনটি সংশোধনের পরামর্শ দেন।

বেশ কয়েকজন কিডনী বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ২০১১ সালে কিডনী বেচাকেনার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকে কিডনী প্রতিস্থাপনের সংখ্যা কমে আসে। বিকল্প খুঁজতেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহকে উৎসাহ দিতে ‘মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধিত) আইন ২০১১’ অনুমোদন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উদ্যোগের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, বিএসএমএমইউ, জাতীয় কিডনী ইনস্টিটিউট, কিডনী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন, ট্রান্সপ্ল্যান্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জনস ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

এ আইনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, মূলত কোন ব্যক্তি বা তার পরিবারের অনুমতিতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করা যাবে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রথম বারডেম হাসপাতালে সফলভাবে যকৃত প্রতিস্থানের সাথে যুক্ত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেছেন, যে দেশে আইনের শাসন নেই, সে দেশের জন্য এমন আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থাকবে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কিডনী রোগ বিশেষজ্ঞ হারুন অর রশিদ ‘ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন এর বিধিবিধান তৈরী না হওয়া ও এবং আইনের সীমাবদ্ধতা থাকার কথা বলেন।

জাতীয় কিডনী ইনস্টিটিউটের পরিচালক জামানুল ইসলাম ভুঁইয়াও এ মর্মে তাঁর মতামত দেন। বাংলাদেশে পদ্ধতিটি জনপ্রিয় করতে ১৯ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। স্বাস্থ্যসচিব এম নিয়াজউদ্দিন জানান, আইনের খসড়া চুড়ান্ত। আশা করা হচ্ছে, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর সংসদের আগামী অধিবেশনেই এটি পাস হবে।

আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের ওপরে এবং ৬৫ বছর বয়সের নিচে আগ্রহী ব্যক্তি তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কে পাবেন, তা তাঁর জীবদ্দশায় লিখে রেখে (উইল করে) যেতে পারবেন। কেউ যদি আগে থেকে উইল না করে যান, ব্রেইন ডেথ ঘোষণার পর তাঁর আইনানুগ উত্তরাধিকারী লিখিত অনুমতি দিতে পারেন। এছাড়া কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেউ যদি মৃতদেহ দাবী না করে, সে ক্ষেত্রে মৃতদেহের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব যার ওপর (সাধারণত জেলা প্রশাসক), তিনি বা তাঁর মনোনীত ব্যক্তি অনুমতি দিতে পারবেন। প্রস্তাবিত সংশোধিত আইনে কোনো ব্যক্তির ব্রেইন ডেথ ঘোষণার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মেডিসিন, নিউরোলজি অথবা ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনে বিশেষজ্ঞ কমপক্ষে ৩ জন চিকিৎসককে। তাঁরা যৌথভাবে ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করবেন। এর বাইরে যে হাসপাতালে রোগী চিকিৎসাধীন থাকবেন, সেই হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করবে। প্রয়োজনে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের একই মর্যাদাসম্পন্ন কমিটির মতামত নিতে হবে।

প্রথমত: যেহেতু রক্ত ছাড়া শরীরের অন্য কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করার বিষয়ে ফকীহ উলামায়ে কিরামের অন্তত অধিকাংশের ঐক্যমত পাওয়া যায়নি এবং আন্তর্জাতিকভাবেও এটি স্বীকৃতি পায়নি; এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এই খসড়া আইনটি পুনর্বিবেচনার দাবী রাখে।

দ্বিতীয়ত: যদিও মানুষ নিজেই নিজের দেহের মালিক নয়; তবুও সে নিজে তার দেহ নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে (ফিকহের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে) হয়তো দান করতে পারতেও পারে বা মরণোত্তর দানের উইল বা অসিয়ত করে যেতে পারে। কিন্তু তার উত্তরাধিকারীরা কোনভাবেই কোনো অবস্থাতেই কোনোক্রমেই মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করার এখতিয়ার বা ক্ষমতা রাখে না। কারণ তারা তার দেহের বা দেহের কোনো অংশের উত্তরাধিকারী বা মালিক কখনো নয়।

তৃতীয়ত: কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃতদেহের দাবীদার বা উত্তরাধিকারী পাওয়া না গেলে প্রশাসন তা যথেচ্ছ ব্যবহারের অধিকারী হবে এটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। যে দেশে ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগে থানা পুলিশ নিখোঁজ ডায়েরী গ্রহণ করে না, যে দেশে সপ্তার পর সপ্তাহ মাসের পর মাস নিরুদ্দেশ মানুষের খোঁজ পাওয়া যায় না; সে সমাজে মাত্র ২৪ ঘন্টা বড্ড কম সময় নয় কি?

চতুর্থত: ব্রেইন ডেথ ঘোষণাকারী ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বার্থপরতা বা ক্ষমতা ও আইনের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগের আশঙ্কা তো রয়েছেই। যে দেশে ডাক্তারের ভুল রোগ নির্ণয় ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়, যেখানে অবহেলায় রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, যেখানে সার্জন যন্ত্রপাতি পেটের ভিতরে রেখে উপরে সেলাই করে দেয়, যেখানে চিকিৎসকের ও হাসপাতালের যোগসাজসে কিডনী ও রক্ত অবাধে বেচাকেনা হয়, যেখানে চিকিৎসকরা হাসপাতাল বা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে দালালের মাধ্যমে রোগী ধরে আনে, যেখানে চিকিৎসকরা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন খায়; যেখানে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে নার্সের সহযোগিতায় দিবালোকে নবজাতক চুরি হয়, যেখানে নামিদামি হাসপাতালগুলো মৃত লাশ জীবিত বলে হিমঘরে রেখে অমানবিক বাণিজ্য করে; সেখানে কাউকে ব্রেইন ডেথ ঘোষণার ক্ষমতা অর্পন করা একটু বেশীই ঝুঁকি থেকে যায়।

অতএব, মানবকল্যাণে প্রস্তাবিত এ খসড়া আইনটি আরো অধিকতর যাচাই বাছাই পর্যবেক্ষণ ও সংশোধনের জন্য দেশের শীর্ষ বরেণ্য আলেমগণের পরামর্শ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যাতে করে ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে কোনো প্রকার ভুল বুঝাবুঝি বা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি না হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সতর্ক দৃষ্টি ও কৌশলী পদক্ষেপ কাম্য।

লেখক : বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়