‘আভ্যন্তরীণ ব্যাপার’। আগে বলেছিলেন কাশ্মির নিয়ে, এখন বলছেন আসামের নাগরিক পঞ্জি নিয়ে। ইনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী। নাগরিকপঞ্জিকে ভারতের ‘আভ্যন্তরীণ’ ব্যাপার ভাববার কোন কারন নাই। ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন বা প্রয়োগ? তাও নয়। এহ বাহ্য। এটা আই ওয়াশ, চোখে বালু মারা, কঠিন বাস্তবতা দেখা, বোঝা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের বিপদ-আপদ বোঝার চেষ্টা আগাম রুখে দেওয়া। এই হোল বারবার ‘ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ নামক পোষ্য কাকাতুয়ার বুলি আওড়ানোর উদ্দেশ্য। কেন?
সহজে বুঝুন। হিন্দুত্ববাদী ভারতের নাগরিকপঞ্জি নির্ণয় এবং একে কেন্দ্র করে প্রচার-প্রপাগান্ডার উদ্দেশ্য একটাই: বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনগণকে হেয় করা, বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে আসামের জনগণকে খেপিয়ে তোলা, সর্বোপরি হিন্দুত্ববাদীদের মুসলমান নির্মূল ও বিতাড়নের রাজনীতিকে পুরা ভারতে পোক্ত করাই এর হীন মতলব। বাংলাদেশীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিশাবে ধরা ও ফেরত পাঠানো সুনির্দিষ্ট ভাবে মুসলমান নির্মূল ও বিতাড়নের রাজনীতি। হিন্দুত্ববাদীরা বলছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অনুপ্রবেশকারী হলেও তারা ভারতে থাকতে পারবে। কিন্তু মুসলমান না। জোর করে মুসলমানকে বাংলাদেশে 'পুশইন' করা হবে। এটাই নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতি। এই রাজনীতি বাস্তবায়নের কৌশল হিশাবে আইন ও আদালতকে হাতিয়ার হিশাবে হিন্দুত্ববাদীরা ব্যবহার করছে।
আসলেই। এটা কোন আভ্যন্তরীণ ব্যাপার স্যাপারের মামলা না। উপমহাদেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যাপার। এমন এক রাজনীতি যা উপমহাদেশে ইতোমধ্যেই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, সহিংসতা ও হানাহানি লাগিয়ে দিয়েছে। এই রাজনীতির মর্মে রয়েছে ঘৃণা, হিংসা, আগ্রাসন ও আধিপত্য।
হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধাবার জন্য বদ্ধ পরিকর। হিন্দুত্ববাদ শুধু ভারত থেকে মুসলমান নির্মূল করতে চায় না, বাংলাদেশ, মায়ানমার থেকেও মুসলমান নির্মূল করতে চায়। এটা তাহলে কিকরে স্রেফ 'ভারতের আভ্যন্তরীণ' ব্যাপার হতে পারে? অতএব নাগরিকপঞ্জী সাড়ে ষোল আনা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের জনগ্ণ অবশ্যই উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত।
কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আগুন লাগা ঘরে বসে নাক ডাকছেন। তার নাসিকা গর্জন শুনতে পাচ্ছি। কারণ হিন্দুত্ববাদী সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জয়শংকর তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন। ঢাকা সফরের সময় ২০ আগস্টের বৈঠকের আগেভাগেই নাকি বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার উত্থাপন করেছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রী সাংবাদিকদেরও সাক্ষী মেনেছেন। সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আপনারা শুনেছিলেন...তিনি (জয়শংকর) স্পষ্ট বলেছিলেন যে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং (বাংলাদেশের জন্য) কোনো সমস্যা হবে না,’ (দেখুন, প্রথম আলো ৩১ অগাস্ট ২০১৯)।
বাংলাদেশে ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে আছে। একদিকে হিন্দুত্ববাদীদের ঘৃণা ও হিংস্রতা, অন্যদিকে বৌদ্ধ জাতিবাদীদের জঘন্য চরিত্র আমরা দেখেছি ও দেখছি। বঙ্গোপসাগর বাদ দিলে বাংলাদেশ তিনদিক থেকে ধর্মীয় জাতিবাদীদের চরম হিংস্রতা, ঘৃণা ও আগ্রাসনের শিকার। মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণকে অবশ্যই সকলকে নিয়ে নিজেদের সুরক্ষার কথা ভাবতে হবে। নিপীড়িত জনগণের মুক্তির লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আস্তিক নাস্তিক ভাগ নাই। একাত্তরে জনগণ ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়েছিল, ফলে উপমহাদেশকে ধর্ম দিয়ে বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িক হানাহানির রাজনীতি বাংলাদেশের জনগন অবশ্যই প্রতিহত করবে।
আমরা পুরা উপমহাদেশে জাতি-ধর্ম-রাষ্ট্র-ভূখণ্ড নির্বিশেষে সকল প্রকার জাতিবাদের বিরুদ্ধে লড়ব। হোক তা ধর্মীয় কিম্বা সেকুলার। ইংরেজের টেনে দেওয়া বর্ডার আমাদের সীমানা না। আমাদের লড়াই পুঁজির বিরুদ্ধে, যে পুঁজি যে কোন দেশে যখন তখন চলে যায়, ডিজিটাল যুগে চলে যায় মুহূর্তে; কিন্তু মানুষের চলাচলে বাধা সৃষ্টির জন্য নিত্য নতুন দেয়াল তোলে পুঁজি। একদিকে রাষ্ট্র ভাঙে, দুর্বল করে, অন্যদিকে মজবুত করে বর্ডার। কাঁটাতারের বেড়া দেয়। জনগণকে ‘ওরা/আমরা হিশাবে ভাগ করে। এ হিন্দু ও মুসলমান শেখায়, তারপর এক পক্ষকে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়।
আমরা এই খেলা খেলব না। ভারতের অভ্যন্তর আমাদের নজরদারির বাইরে নাই। আমরা ‘রাষ্ট্র’ নই। আমরা উপমহাদেশের জনগণ। আমরা পারি। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :