শিরোনাম
◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও) ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না: সুপ্রিমকোর্ট ◈ তীব্র গরমে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা আরও ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা ◈ সিরিয়ায় আইএসের হামলায় ২৮ সেনা নিহত ◈ সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য: রিজভী 

প্রকাশিত : ২৫ আগস্ট, ২০১৯, ০২:৫০ রাত
আপডেট : ২৫ আগস্ট, ২০১৯, ০২:৫০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ইসলামি সঙ্গীতের বৈধ-অবৈধ চিহ্নিত করার বিশেষজ্ঞ মুফতি না থাকায় একে অন্যের গানকে বিভিন্ন অজুহাতে নাজায়েজ বলে

মনযূরুল হক : ‘ইসলামি সঙ্গীত’ বলে সঙ্গীতশাস্ত্রে কোনও ধারা নেই এবং ইসলামেও ‘ইসলামি সঙ্গীত’ নামে কোনও পরিভাষা নেই। ‘ইসলামি সঙ্গীত’ হলো একটা ধারণা। সমকালীনবিশ্বে বিপুল পরিমাণ ইসলামপন্থী গায়ক ইসলামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সুর করে গায় এবং এটাকেই তারা ইসলামি সঙ্গীত বলে। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, তারা নিজেরাই একে অন্যের গানকে বিভিন্ন অজুহাতে না-জায়েজ বলে। যা না-জায়েজ, তা তো ইসলামি হতে পারে না। আবার ইসলামি সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ মুত্তাকি মুফতির দেখাও আমরা পাই না, যিনি প্রতিটি অনুষঙ্গ ধরে ধরে, ইনস্ট্রুমেন্ট বুঝে বুঝে কোনটা বৈধ বা কোনটা বৈধ নয়, তা চিহ্নিত করে দেবেন। কোনও সেন্সরবোর্ড বা অথরিটিরও দেখা পাইনি আমরা।

বিষয়টা হলো, একটা সঙ্গীতে তিনটি প্রধান অনুষঙ্গ থাকে—কথা, সুর ও বাদ্য। তো এই তিনটার বিচারেই জায়েজ নাকি নাজায়েজ তা নির্ধারণ করা হয়। যারা অন্যের সঙ্গীতকে নাজায়েজ বলেন, তারাও এই তিনটার কোনও একটার গলতি ধরে নাজায়েজ বলেন। হয়তো বলেন ‘তার সুর গানের মতো’, কিংবা বলেন ‘তার কথা শিরকি’, কিংবা বলেন ‘তার সঙ্গীতে বাজনা আছে, বাজনা জায়েজ নেই’ ইত্যাদি। এইভাবে সবার কথা বিবেচনায় নিলে একটি সঙ্গীতও ‘ইসলামি’ বলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো—সুর, সঙ্গীত ও বাজনাকে ইসলামের মৌলিক বিচার থেকে বিবেচনা করলে প্রচলিত ধারার অনেক গানও সুর ও কথার বিচারে জায়েজ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাহলে সেইসব গানকে কি আপনি ‘ইসলামি সঙ্গীত’ বলতে পারবেন কিংবা বলছেন?

কেউ কেউ আবার ‘ইসলামি সঙ্গীত’ বলে গজল বোঝাতে চায়, কিংবা ‘গজল’কে ‘ইসলামি সঙ্গীতে’ হিসেবে আখ্যা দেয়। কেউ আবার আরবিতে ‘নাশিদ’ বলে। এগুলো সবই হলো সঙ্গীত সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞতার ফসল। ‘নাশিদ’ কোনও ইসলামি সঙ্গীত শাস্ত্রীয় পরিভাষা নয়। আরবি ভাষায় ‘আন-নাশিদুল ওয়াতানি’ মানে হলো ‘জাতীয় সঙ্গীত’। যেমন জর্ডানের জাতীয় সঙ্গীতকে বলা হয় ‘নাশিদু উরদুন আল-ওয়াতানি’। তো ইসলামি সঙ্গীত দ্বারা আপনি কি কোনও দেশের জাতীয় সঙ্গীতকে বোঝেন?

আর ‘গজল’ হলো সঙ্গীতশাস্ত্রের একটি বিশেষ ধারা। আমরা ভাওয়াইয়া বা ভাটিয়ালি বলতে যেমন গানের বিশেষ ধারাকে বুঝি, তেমন—বরং আরও বিস্তৃত। এভাবে নৃত্যেরও অনেক ধারা আছে। তো গজল হলো একজাতীয় প্রেমসঙ্গীত। সেই প্রেম পার্থিব কিংবা অপার্থিব হতে পারে। উর্দু ও ফার্সি ভাষায় এই গীতধারার সৃষ্টি হয়েছে এবং চর্চাও হয়েছে এইদুটি ভাষাতেই সবচে’ বেশি। বাংলায়ও কিছু হয়েছে নজরুলের হাত ধরে। রুমি, আত্তার ও হাকিম শানাঈ হলেন ফার্সি ভাষায় গজলের প্রধান রচয়িতা। উর্দুতে আমির খসরু গজলের জন্য খ্যাতি কুড়িয়েছেন; গালিব, তকি মীর ও ইকবালও লিখেছেন। গজল ভালো গাইতে হলে ভালো ভাষা-জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এর দুটি পক্ষ আছে : সাহিত্য পক্ষ ও সঙ্গীত পক্ষ। সাহিত্য পক্ষে কাব্য মূল ভূমিকা পালন করে। কাব্য আবার দুভাগে বিভক্ত : তগজ্জুল ও তসব্বুফ। আবার প্রতিটিতে দুটি পর্ব আছে : রাগ পর্ব ও তাল পর্ব। রাগ পর্বে শৃঙ্গার রসের সহায়ক রাগগুলো গজল গানে ব্যবহৃত হয়। টপ্পা ও ঠুমরির মতো গজল প্রধানত কাফি, পিলু, ঝিঝিট, খাম্বাজ, বারোয়া, ভৈরবী রাগে গাওয়া হয়। এসব নিয়ে সংক্ষেপে আলাপ করাও মুশকিল।

গজলকে এক কথায় সুফিগান বলা যায়। হিন্দু ও মুসলিম উভয় জাতের গায়করা গজল চর্চা করেন, করেছেন। ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী জগজিৎ সিংকে বলা হয় গজল সম্রাট। লতামঙ্গেশকরের সাথে তার বিখ্যাত অ্যালবাম ‘সাজদা’ হলো উপমারহিত গজলের সঙ্কলন। স্বামী বিবেকানন্দও গজল শিখেছিলেন। একসময় ধ্রুপদি সঙ্গীত হিসেবে অভিজাত পরিবারে গজল শেখার প্রচলন ছিল।

প্রসঙ্গত বলতে হয়, গজল শব্দটি আরবি এবং আরবি কবিতার একটা ধারাকেও ‘গজল’ বলে। ‘আফিফ’ ও ‘সরিহ’ নামে আরবি গজল-কবিতার ভিন্ন ভিন্ন ধারা আছে। এর অরিজিন হলো কাসিদা। কাসিদাকে ‘নাসিব’-এর একটি ধারা মনে করা হয়। এই ধারার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো ‘সাবাআ মুয়াল্লাকা’। গ্রিক পানেজিরিকস (Panegyric) থেকেই মূলত এই প্রশস্তিমূলক কাব্যধারার আবির্ভাব। আরবিতে বলে ‘মাদিহ’। আমরা যেমন হামদ বা নাত বলি, তেমন। সাহাবিদের মধ্যে কাব বিন যুহায়ের, হাসসান বিন সাবেত ও আলী রা. গজলের চর্চা করেছেন। সাহাবিদের মধ্যে এইভাবে যারা গজল-কাব্যের চর্চা করেছেন, রসুলের যুগে কিন্তু তাদের উল্লেখ করে ‘ইসলামি কবি’ বা ‘ইসলামি কবিতা’ বলা হয়নি—‘শায়েরে রসুল’ বলা হয়েছে।

বস্তুত একইভাবে ‘ইসলামি সাহিত্য’ বা ‘ইসলামি ফৌজ’ বলাও অনুচিত। কেননা, ইসলাম হলো একটি ক্লেদমুক্ত, নির্মল, নির্মেদ ও নিষ্কলুষ জীবনধারা। সুতরাং কারও সাহিত্যে যদি সামান্য ক্লেদ বা কলুষ থাকে, কিংবা কোনও সৈনিকের জীবনধারায় যদি গর্হিত কিছু পাওয়া যায়—পাওয়া যাওয়াটাই স্বাভাবিক—তদুপরি তো তাকে আপনি ‘ইসলামি’ বলে আখ্যায়িত করতে পারেন না। তাহলে প্রকারন্তরে ইসলামকে ক্লেদমুক্ত বলা হয়। একান্ত কোরআন-হাদিসের টেক্সট বা এইপর্যায়ে উন্নীত সাহিত্যকেই ইসলামি সাহিত্য বলা যেতে পারে—অন্যথায় নয়। এভাবে একমাত্র সাহাবিদের সেনাদলকেই ইসলামি ফৌজ বলা যায়—অন্য কোনওটাকে নয়।

একই কথা ‘ইসলামি সঙ্গীত’ বলার বেলায়ও। ‘ইসলামি সঙ্গীত’ কোনও পরিভাষা হতে পারে না। সমকালে যারা ইসলামি ভাবধারার সঙ্গীত গাইছেন, তারা হয়তো পপ সঙ্গীত গাইছেন, কিংবা রক গাইছেন, বা পল্লীগীতি গাইছেন। অনেকে মরমি সঙ্গীতও গাইছেন। শাস্ত্রীয় বিচারে ইসলামপন্থীদের মধ্যে কেউ গজল গাইছেন, তা অধমের চোখে পড়েনি। তো অধমের মতে, ‘ইসলামি সঙ্গীত’ না বলে, এ-ধরনের সঙ্গীতকে এক কথায় বলতে গেলে ‘ইসলামি ভাবধারার সঙ্গীত’ বলা যেতে পারে। ইংরেজিতে সাম (Psalm) বা ওড (Ode) বলে যেসব ধর্মীয় প্রশংসাগীত বা গাথা বলা হয়, তার সঙ্গে এগুলোর তুলনা করা যায়।

এইসব আলোচনার মানে কিছুতেই এটা নয় যে, ইসলামপন্থীদের মধ্যে যারা গাইছেন, তাদের সঙ্গীতগুলো শরিয়তসম্মত হচ্ছে না, কিংবা তার প্রয়োজন নেই। আমি কেবল ‘পরিভাষা’টা বিচার করছি। প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। বিরাট একটি অংশ সুন্দর কথামালা উপহার দিচ্ছেন এবং প্রচলিত গানের ধারাতে যে নষ্টামি চলছে, আমাদের সন্তানদের সুস্থ বিনোদন উপহার দেওয়ার জন্য, একজন মুজাহিদ বা দায়ীর প্রেরণার জন্য এমন সঙ্গীতের প্রয়োজন অশেষ। এর মানে এ-নয় যে, এগুলোকে ‘ইসলামি সঙ্গীত’ বলেই নামকরণ করতে হবে।

দেখুন, বৈধ কিছু বোঝাবার জন্য নতুন কোনও পরিভাষার দরকার হয় না। ধরুন, আপনি আম খাবেন। তো যদি এর উপাদানের সাথে হারাম কিছু না মেশান, যদি হালাল উপার্জন থেকে খান, যদি চুরি করে না-খেয়ে থাকেন, যদি সুন্নাত মোতাবেক পরিচ্ছন্ন করে খান, তাহলেই সেটা ইসলামে বৈধ হবে—এজন্য তো নতুন ইসলামি নামকরণের দরকার নেই। অর্থাৎ তার জন্য আমগাছকে ‘ইসলামি আমগাছ’ বলে আখ্যায়িত করতে হবে না। সুতরাং যারা ইসলামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে গান গাইছেন, তাদের গান যদি গজলগীত হয়, তো তারা গজল গাইছেন, খেয়াল গাইলে সেটা খেয়াল হবে, পপ গাইলে পপসঙ্গীত হবে, রক গাইলে রক গাওয়া হবে; এভাবে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া যা গান, সেটাই যদি বৈধ কথা, সুর ও বাদ্যসমেত হয়, তাহলেই সেটা বৈধ ও ইসলামসম্মত হবে—নচেৎ নয়। এ-জন্য নতুন করে ‘ইসলামি সঙ্গীত’ নামক পরিভাষা লাগাতে হবে না। এই পরিভাষা ইসলামকে কোনওভাবে উন্নত করে না, বরং বহুক্ষেত্রে হাস্যকর প্রতীয়মান করে। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দিন। সূত্র: ফাতেহ২৪

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়