আলী হাসান উসামা : কুরবানি নিজেই কুরবানি। কুরবানিকে পুনরায় কুরবানি করার কিছু নেই। প্রত্যেক জাতির আনন্দের দিন থাকে। মুসলমানদের আনন্দের দিন বছরে দুটো। এ দুই দিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিরানন্দে ছেয়ে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। ইবাদতের পন্থা সুনির্ধারিত। ইবাদতের পন্থা শুদ্ধভাবে শিখতে হলে তাকাতে হবে রাসুল এবং সাহাবিদের সিরাতের দিকে। তারা যেভাবে করেছেন, তা-ই বিশুদ্ধ এবং যথার্থ পথ। হ্যাঁ, কখনো যদি দীনি প্রয়োজনের খাতিরে আনন্দকে কুরবানি করতে হয়, দীনের জন্য নিজের জীবন সম্পদ বা সময় বিকাতে হয়, তা তো ভিন্ন বিষয়, তা তো পরম আনন্দের বিষয়। কারণ, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ।’
শিশু-কিশোরদের জন্য সারাবছর বাইরে বাইরে থেকেও ঈদের দিনগুলোতে পরিবারের সঙ্গে না থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাইরে থাকা খুব ভালো কোনো কাজ মনে হয় না। যেমন : ঈদের দিনগুলোতে দাওয়াত ও তাবলিগের সফরে বের হওয়া, কোনো শাইখের সোহবতে দূরে কোথাও অবস্থান করা ইত্যাদি কাজ এ সকল দিনে না হয়ে অন্যান্য দিনে হওয়াই আমার দৃষ্টিতে সংগত।
কওমি মাদরাসাগুলো যেহেতু সরকারের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, সরকারের কোনো দান-অনুদানও তারা গ্রহণ করে না, যদিও বর্তমানে একশ্রেণীর মৌলবি কওমির পরিচয়ধারী হয়েও সরকারের পা চাটাকেই ইবাদত মনে করে, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এটা কওমি মাদরাসার স্বাভাবিক নীতি ও রীতি নয়। তো, যেহেতু কওমের অর্থায়নেই কওমি মাদরাসাগুলো চলবে, তাই কুরবানির দিনগুলোতে কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবক তালিবে ইলম থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তারা মানুষের বাসায় বাসায় যাওয়ার চাইতে কোনো এক পয়েন্টে ব্যানারসহ থাকা এবং সেই পয়েন্টে এসে আগ্রহী মুসলিমরা চামড়া দিয়ে যাওয়াই বাহ্যত সুন্দর এবং আত্মমর্যাদাপূর্ণ পন্থা মনে হয়।
এই কাজকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ মাদরাসায় শ্রম দিতে পারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাদরাসাগুলোরও উচিত হবে তাদের যথার্থ মূল্যায়ন করা। সেই স্বেচ্ছাসেবকদের সাধ্যমতো সম্মানী দেওয়া।
মাদরাসায় শিক্ষকরা এসেছেন দীনের খেদমত করার জন্য। তাদের নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মাদরাসা কীভাবে চলবে, এটা দেখা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। শিক্ষকরা তাদের শিক্ষকতার কাজে সর্বদা মশগুল থাকবেন। আর কর্তৃপক্ষ থাকবে তাদের খেদমতে মশগুল থাকবে। যদি কর্তৃপক্ষ নিজেরা ব্যস্ততার দরুন এই কাজটা না পারে তাহলে প্রয়োজনে এর জন্য আলাদা লোক নিয়োগ দেবে। কিন্তু শিক্ষকদের এসব কালেকশনে লাগিয়ে দেওয়া এবং এ ব্যাপারে তাদের বাধ্য করা কোনো আদর্শ রীতি নয়।
একইভাবে মাদরাসায় ছাত্ররা আসে ইলম শেখার জন্য। তাদের খেদমত করতে পারা কর্তৃপক্ষের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। এমন নয় যে, এর মাধ্যমে তারা ছাত্রদের ওপর অনুগ্রহ করছে। বরং আল্লাহ যে তাদের তালিবুল ইলমদের খেদমতে কবুল করলেন, এটা তাদের ওপর মহান আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ। এ জন্য সাধ্যানুসারে কালেকশনের কাজে ছাত্রদের খাটানোও অনুচিত।
হ্যাঁ, বিশেষ দু-একটা ইস্যুতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যদি কিছু ছাত্রের থেকে খেদমত নেওয়াও হয় তবে এ জন্য তাদের উপযুক্ত সম্মানী দেওয়া উচিত। এসব দান-অনুদানের কাজে লাগিয়ে ছাত্রদের বছরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বা এক-পঞ্চমাংশ সময় নিয়ে নেওয়া একে তো তাদের লেখাপড়ার জন্য ক্ষতিকর; উপরন্তু এ বয়সে এ কাজে জড়িয়ে গিয়ে তারা হারিয়ে ফেলে ইলমি আত্মমর্যাবোধ, তাদের মানসিকতা এবং চিন্তার পরিসরও হয়ে যায় ক্রমে ক্রমে সংকীর্ণ।
কওমি মাদরাসা কওমের অর্থায়নেই চলবে, আর কওমের থেকে অর্থ/দান সংগ্রহের জন্য সুব্যবস্থাও থাকবে—এ ব্যাপারে তো কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু প্রয়োজন দান সংগ্রহের পদ্ধতিতে সংস্কার আনা। নিজেদের আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে মুসলমানদের সাধারণ দান সংগ্রহের পথ আবিষ্কার করা। কোনো জায়গায় কর্তৃপক্ষ নিজেরা স্বশরীরে অথবা আলাদা লোক নিয়োগের মাধ্যমে যদি এই সাধারণ কাজটা আঞ্জাম দিতে না পারে তাহলে তাদের কে বলেছে, মাদরাসা খুলে রাখতে! দেশে তো মাদরাসার অভাব নেই। মাদরাসা প্রয়োজনে কম হোক। কিন্তু যেগুলো হবে, সবগুলোতে নৈতিকতা এবং শৃঙ্খলা থাকুক। ময়দানে হাজারো ছাগল মিলেও কি একটা ঘোড়ার কাজ দিতে পারে? ঘোড়া প্রয়োজন; হোক না তা পরিমাণে কম। কী হবে এত এত ছাগল দিয়ে!
আজ কওমি মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতা নেই। যুগের ফিতনার মোকাবেলা করে জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার যোগ্যতা নেই। চিন্তাধারায় এখনো সেই সেকেলেপনা। আত্মমর্যাদাবোধ তো হারিয়েছে সেই কবেই। এ জাতিকে অবশ্যই জাগতে হবে। আড়মোড় ভেঙে এখনই জ্বলে উঠতে হবে। এদেরকেই তো ধরতে হবে আগামী পৃথিবীর হাল। ঢের সময় তো চলে গেছে। আর কত! রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি!’ ফেসবুক থেকে