মুক্তশ্রী চাকমা সাথী : ঘটনা এক : চট্টগ্রামের হালিশহরে এক মা তার বাচ্চাকে নিয়ে হাঁটছিলেন, ছেলেধরা সন্দেহে তাকে ‘জনগণ (অমানুষ)’ মারা শুরু করলো। কিছু আসল মানুষ তাদের জানবাজি রেখে ওই নারীকে বাঁচালেন । ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বাচ্চা মার কোলে প্রাণপণে ঝুলে আছে মা যখন দোকানে ঢুকে বাঁচার চেষ্টা করছেন তখনো...
ঘটনা দুই : আমাদের জ্ঞান ( ১৫/১৬ ) বছরে পা দিয়েছে... আমি ৩৫ দিন পর বাসায় ফেরার আধা ঘণ্টার মধ্যে সে বললো... তার মা তাকে খবর দিয়েছে মাথা কেটে নিয়ে যাবে সে যেন বাসায় চলে যায়। পড়ালেখা করার দরকার নেই। খবর হলো রক্তের নমুনা স্কুলে স্কুলে নেয়া হবে। যারা দেবে না, সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে জোর করে তাদের কাছ থেকে নেয়া হবে। রক্তের গ্রুপ মিললে মাথা চালান হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে (যাদের জীবনের মূল্য নেই তারা কাজে লাগবে... এই হলো মোদ্দা কথা)। ক্লান্ত-শ্রান্ত আমি তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে গোছানোর চেষ্টা করছি আর ভাবছি... কি বলে আমি তাকে আশ্বাস দেবো, বলবো এসব গুজব। কি বললে সে বিশ্বাস করবে সেনাবাহিনী আমাদের সঙ্গে এমন করবে না কখনো...
কোনো রকমে বললাম... মাথা দিয়ে যদি সেতু বানানো যেতো। তাহলে এতো ইঞ্জিনিয়ার পড়তো না / কাজ করতো না। সে যেন ভয় না পায়। ঘটনা তিন : আমার বাচ্চা ৮ মাসের + অসুস্থ হওয়ায় কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে বান্দরবান হয়ে রাঙ্গামাটি আসতে চেয়েছিলাম। কক্সবাজার হতে চিটাগাং হয়ে রাঙ্গামাটি আসতে সময় লাগে ৯/ ১০ ঘণ্টা। বান্দরবান হয়ে আসতে লাগে ৩/৪ ঘণ্টা। বারবার অনুরোধ করার পরও আমার সাদা জামাইয়ের নিরাপত্তার দোহাই দেখিয়ে ৮ মাসের বাচ্চার জীবন সাদা চামড়ার নিরাপত্তার চেয়ে কম তা বান্দরবানের রেইচা আর্মি চেক পোস্ট, বান্দরবানের ডিএসবি কনস্টেবল দেলোয়ার ও সেনাবাহিনী বুঝিয়ে দিলেন। সাদা জামাইয়ের রাঙ্গা থাকার পারমিশন, আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের মেয়ে (বাংলাদেশের নাগরিক), ৮ মাসের বাচ্চা অসুস্থ কোনো কারণই ওই পোস্টের সেনাবাহিনীর/ডিএসবির কাছে... আমি বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সংযোগ রাস্তা ব্যবহার করতে পারি বলে যথেষ্ট কারণ বলে মনে হলো না। তারা বান্দরবান রাঙ্গামাটি সড়ক ব্যবহারকালে সাদা চামড়ার ‘যদি কিছু হয়’ তাহলে তাদের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণœ হবে এই আশংকায় ৮ মাসের বাচ্চার অসুস্থতা, আদিবাসী হিসেবে পরিবারসমেত আমার রাস্তা ব্যবহারের অধিকার অগ্রাহ্য করাটাই সমীচীন মনে করলেন। উপরের তিনটা ঘটনাই বলে দেয়... সমাজের ক্ষমতা কাঠামোয় নিচু সিঁড়িতে অবস্থানকারীদের কি ধরনের অনিরাপত্তা, অবিশ্বাস ও ভয়, বৈষম্যের ভেতর দিয়ে টিকে থাকতে হয়। যারা মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলছেন তারাও কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সমাজ কাঠামোর নিচু সারিরই লোক। কেন মারছেন? কারণ তাদের আর এদেশের আইনের উপর আস্থা নেই। ওই বিশ্বাসটা আর নাই যে... যাদের বিচার করার কথা, যাদের আমাদের জীবন সহজ ও নিরাপদ করে তোলার কথা তারা তাদের কাজটুকু করবে। যেহেতু বিশ্বাস নেই সেহেতু সবাই এখন ‘ধরো তক্তা, মারো পেরেক’ নীতি নিচ্ছে । এক একটা দিন বেঁচে আছেন এদেশে তো বুঝে নেন আজ আপনার আরও একটা দিন টিকে থাকার যুদ্ধে নামার ডাক। সেলিব্রেট করার মতো একটা দিন কারণ আজ টিকে গেলেন। এমন করেই আমরা টিকে থাকি। বাঁচার মতো করে বাঁচার আশা এই মরার দেশে করে লাভ নেই... শুধু টিকে থাকা... অনিরাপত্তা, অবিশ্বাস ও ভয়, বৈষম্যের ভেতর দিয়ে টিকে থাকা। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :