শিরোনাম
◈ অবশেষে মার্কিন সিনেটে সাড়ে ৯ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ পাস ◈ কক্সবাজারে ঈদ স্পেশাল ট্রেন লাইনচ্যুত, রেল চলাচল বন্ধ ◈ ইউক্রেনকে এবার ব্রিটেননের ৬১৭ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা ◈ থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ◈ জিবুতি উপকূলে অভিবাসীবাহী নৌকাডুবিতে ৩৩ জনের মৃত্যু ◈ লোডশেডিং ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে, চাপ পড়ছে গ্রামে ◈ এফডিসিতে মারামারির ঘটনায় ডিপজল-মিশার দুঃখ প্রকাশ ◈ প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আয়ে ১৫.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ◈ প্রথম ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাত চেয়ারম্যানসহ ২৬ জন নির্বাচিত ◈ বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ আহ্বান রাষ্ট্রপতির

প্রকাশিত : ২০ জুলাই, ২০১৯, ০৮:০৯ সকাল
আপডেট : ২০ জুলাই, ২০১৯, ০৮:০৯ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রিফাত হত্যা, মিন্নির জবানবন্দি ও পুলিশের ভূমিকা

ফজলুল বারী: আওয়ামী লীগের সারাদেশে ভালো লোকজনের পাশাপাশি বেশকিছু খারাপ লোকও আছে। দলটি টানা ক্ষমতায় থাকার কারণেও খারাপ লোকগুলোর গায়ে-গতরে চর্বি বেশ বেড়েছে। মাঝে মাঝে উগড়ে উপচে ফেনী-বরগুনার মতো বেরোয় এদের পাপ। অথচ এরা মূলত শেখ হাসিনার পরিশ্রমী নেতৃত্বের ওপর ভর করে নানান দাপট-আকামকুকাম করে খায়। প্রভাব দেখিয়ে বেঁচেবর্তে থাকে। এদের পাপ-তাপে বদনাম হয় দলের। শেখ হাসিনার। এরপরও এদের পাপ-তাপ ধারণ করে বেঁচে থাকেন দলনেত্রী। বরগুনার ঘটনাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর প্রভাবে তার ছেলে সুনাম দেবনাথের পাপের প্রকাশ। মাদকাসক্ত এবং মাদক ব্যবসায়ী নয়ন বন্ড গ্রুপটি সুনামের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই দিনেদিনে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। এরা লোমহর্ষক একটি ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশ এখন ব্যস্ত গডফাদারের ফেসসেভিং’এ। পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা বলছেন, ধরে ফেলেছি। মাদকটাদক কিচ্ছুনা। এটি পোলাপানের গভীর ষড়যন্ত্র। ব্যক্তিগত রেষারেষির প্রকাশ। এতে করে আড়াল হচ্ছে গডফাদারের ইজ্জত। তার ইজ্জত মানে এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ইজ্জত। দুষ্ট জনপ্রতিনিধি গায়ে দাগ পড়ে এমন কিছু করার সাহস বাংলাদেশের সব পুলিশ অফিসারের নেই। বুদ্ধিমানরা জানেন যারা এসব সুচারু করতে পরিচালনা করতে পারেন তাদের আপাতত আখের ভালো হয়।

খেয়াল করে দেখবেন তরুণ এই গডফাদারের কাজকর্ম আবার কিছুটা বুদ্ধিজীবী কিসিমের। নানা বিষয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে নির্দেশনা দেন। যেমন রিফাত খুনের পর দেয়া স্ট্যাটাসে রিফাত ফারাজি-রিশান ফারাজিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন এরাতো দেলোয়ার হোসেন ভায়েরা ভাই’র ছেলে। তিনি বিশুদ্ধ-ফুলের মতো পবিত্র চরিত্র। অথচ বরগুনার ওয়াকিবহালরা এখন সেখানকার রাজনীতিতে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের অবস্থান জানেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দুই গ্রুপ। সভাপতি সুনামের বাবা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির ঐতিহ্যগতভাবে ক্যাডার রাজনীতির ধারক-বাহক। ছাত্রলীগের কাণ্ডারি নেতা জাহাঙ্গীর কবিরের ছেলে। জেলার ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্তৃত্ব সাধারণ সম্পাদকের দখলে। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিরতো একটা গ্রুপ দরকার। বাবার প্রতি ভালোবাসায় সুনাম দেবনাথ এই গ্রুপটি গড়ে তুলেছিলেন নয়ন বন্ড জাতীয়দের নিয়ে। এই গ্রুপটিকে বরগুনার লোকজন ভয় পেতো। ভালোবাসতোনা। এদেরতো ভালোবাসা যায়ওনা। নিহত রিফাতও একসময় এই গ্রুপের সদস্য ছিলো। ছিটকে গেছে।

বরগুনার বর্তমান এসপি মারুফ হোসেনের সঙ্গে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বা তার ছেলে সুনাম দেবনাথের সম্পর্ক একসময় ভালো ছিলোনা। তাদের পছন্দের এসপি বিজয় বসাককে দলের শত্রুপক্ষ বরগুনা থেকে বিদায় করেছে। মারুফ হোসেন পুলিশ পদক পাবার পর সুনাম দেবনাথ তার প্রশংসা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। ভালোবাসার সূত্রপাত সেখান থেকে। রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও দেশব্যাপী ভাইরাল-হৈচৈ সৃষ্টির পর এক মধ্যরাতে পুলিশ সুপার সুনামকে তার অফিসে বৈঠকে ডাকেন। এরপর নয়ন বন্ড কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়। অতএব এখন পুলিশ সুপার বা নয়ন যেখানে যা বলছেন এর কোন সাক্ষী নেই। ধরা পড়ার আগে গোপন অবস্থান থেকে মিন্নিকে ফোন করে শাসিয়েছে নয়ন। মিডিয়ায় তার কথাবার্তার জন্য মিন্নিকে শাসানো হয়। এখন গোপন অবস্থান থেকে নয়ন যে মিন্নিকে ফোন করেছে এটিকে প্রমাণ ধরেই মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুনামের ফর্মুলায় সন্তুষ্ট হয়েছেন এসপি। মিন্নি বাইরে থাকাটা তাদের কারো জন্যে নিরাপদ নয়। প্রায় সে মিডিয়ার সাথে কথা বলে। এটি চলতে দেয়া যায় না।

পরিকল্পনা অনুসারে দুটি এডিটেড ভিডিও ফুটেজ প্রচারের ব্যবস্থা করেন। রিফাতকে কোপানোর ভাইরাল ফুটেজটি আশেপাশের কোন ভবন থেকে কে তুলে ফেসবুকে দিয়েছে সেই বেয়াদবটার সন্ধান এখনও পুলিশ বা সুনাম কেউ বের করতে পারেনি। সব অনাসৃষ্টির মূলতো সেই ফুটেজ। কারণ এমন ঘটনা বরগুনায় আগেও ঘটেছে। ফুটেজ ভাইরাল হয়নি তাই কোন সমস্যা হয়নি। এখন সেই ফুটেজ দেখে যারা আহ-উহ করাদের মনে মিন্নি সম্পর্কে ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে বাকি দুটি ফুটেজ প্রকাশ করা হয়। এর একটিতে দেখা গেছে স্বামী রিফাত কলেজগেটে আসার পর তাকে দেখেও মিন্নি ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলেন। এরমানে রিফাতকে খুন করাতেই সেখানে ডেকে এনেছেন মিন্নি। এ নিয়ে মিন্নি বলেছেন তার স্বামী ফানি টাইপের ছিলো। তার শ্বশুরও এসেছেন এটা ফান করে বলায় সে লজ্জা পেয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। দ্বিতীয় ফুটেছে বলা হয় এতো বড় ঘটনার পর মিন্নি স্যান্ডেল খুঁজে রিকশায় করে চলে যাচ্ছে। অতএব সেই হলো গিয়ে আসল খুনি। আগেই বলা হয়েছে সুনাম দেবনাথের একধরনের বুদ্ধিজীবী ভাব-টাইপ আছে। নানাকিছুতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস-পোষ্ট দেন। তাদের এডিটেড ফুটেজ পোষ্ট করার সময় সেখানেও বলা হয় মিন্নিই আসল খুনি। যেন পুলিশ মিছেমিছি বা ভুল করে তার প্রিয় নয়ন বন্ডকে মেরে ফেলেছে। আহা!

পাণ্ডুলিপির এ পর্বে রিফাতের বাবাকে দিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করা করা হয়। এর পুরো আয়োজন করেন সুনাম দেবনাথ। মামলার এক নাম্বার সাক্ষী এবং পুত্রবধূকে গ্রেপ্তার দাবি করেন রিফাতের বাবা। মিন্নিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করেন সুনাম। সেখানে বক্তৃতায় তার শব্দচয়নে অনেকে চমকে যায়। মামলায় আর কোন আসামীর শাস্তি চাইছিলেন না তিনি। একটাই দাবি মিন্নিকে গ্রেপ্তার করে শাস্তি দিতে হবে। বরগুনার সূত্রগুলো বলছে একাত্তর টিভির একাত্তর জার্নালে সংযুক্ত হয়ে মিন্নি বক্তব্য দেয়ায় ক্ষিপ্ত হন সুনাম। এ ঘটনার পর তাকে তারা আর বাইরে রাখাটা নিরাপদ মনে করেননি। মিন্নির পক্ষে যে কোন আইনজীবী কোর্টে দাঁড়াননি এর কারণ হিসাবেই সুনাম দেবনাথের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে অনেকে দায়ী করেন। এই যে ছোটবাবু সবকিছুতে স্ট্যাটাস দেন ফেসবুকে। আরেকপক্ষের বক্তব্য সুনাম আইনজীবীদের মধ্যে অত প্রভাবশালী নন। নুসরাতের ঘটনায় আসামীদের পক্ষ নেয়ায় আইনজীবীদের সমালোচনা হওয়াতে অনেকে হয়তো বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
বরগুনার ঘটনার নানাকিছু সুনামের মতো করে অথবা সুনামের সুনাম রক্ষার কায়দায় বলে ফেলেছেন পুলিশ সুপার! বলেছেন এটি ব্যক্তিগত রেষারেষির ঘটনা। এখানে নিহত রিফাত সহ সবগুলোই যে মাদকাসক্ত, আগেপরে এরা সবাই যে মোটামুটি সুনাম সমিতির সভ্য, ব্যবসার খেদমতগার এই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছেন। কারণ পাণ্ডুলিপি সে রকমই লেখা। বলা হয়েছে খুনের প্রস্তুতি মিটিং’এও মিন্নি ছিলো! এসপি সাহেবরা অনেক বড়মাপের ব্যক্তিত্ব। মিন্নি টাইপ ছেলেমেয়েদের বয়স-যোগ্যতা মাথায় রেখে যদি ধারনাও করা যায় খুনের জন্যে তারা গভীর ষড়যন্ত্র বৈঠক করেছে তাহলে এসপি মারুফ হোসেনের এলাকাটি যে কি ভয়ংকর বিপদজনক তা মানতে হবে!

ঘটনাটি নিয়ে বরগুনার নানাপক্ষের সঙ্গে কথা বলে একটি ধারনা পাওয়া গেছে। মিন্নি রিফাত দু’জনও মাদকাসক্ত অথবা নয়ন বন্ড গ্রুপের সদস্য ছিল। নানাকিছুতে এরা তাদের বস নয়নের কাছে অভিযোগ করতো। বিচার দিতো। একটি ফোনসেট নিয়ে রিফাত-মিন্নির মধ্যে ঝগড়া হয়। মিন্নি এ নিয়ে তাদের লিডার নয়নের কাছে বিচার দেয়। তখন মিন্নিকে বলা হয়েছিল রিফাতকে বকে দেয়া হবে। কিন্তু এই বকে দেয়া মানে যে রিফাতকে কোপানো হবে এটি ভাবতে পারেনি হতভম্ব মিন্নি। এই নয়নকে রিফাত একবার ধরিয়ে দেয়ায় তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। এরপর আবার রিফাত মিন্নিকে বিয়ে করেছে। নয়ন হয়তো এই সুযোগে জমানো ক্রোধের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে রিফাতের বিরুদ্ধে। বরগুনার অনেকে বলেছেন বকে দেবার কথা বলে ডেকে আনা রিফাতকে এভাবে কোপানো হবে এটি মিন্নি জানতোনা। আবার রিফাত যে মরে যাবে এটিও ভাবেনি নয়ন। কারণ তার আগের ঘটনাটির শিকার বেঁচে গেছে। এই ঘটনার পরও রিফাত একা একা হেঁটে গিয়ে রিকশায় উঠেছে। মোটা দাগে বরগুনার ঘটনা, এক প্রভাবশালী চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর প্রশ্রয়ে পুষ্টদের অবক্ষয়ের ঘটনা। পাণ্ডুলিপির এ পর্বটির শিরোনাম ‘তাহার আড়াল’!

বরগুনার ঘটনার চলতি পর্বে সোশ্যাল মিডিয়া বিভক্ত। রিফাতকে কোপানোর ভিডিও দেখে ক্ষুব্ধ-বেদনার্তদের চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দিতে এডিটেড যে দুটি ফুটেজ রিলিজ করা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্য সফল। এপক্ষের ওয়ালে ছিঃ মিন্নি, কুলটা মিন্নি রব! এটিই বাংলাদেশের পুরুষতন্ত্র। যেখানে ছেলেরা সুযোগ পেলে প্রেম করে, আরও একটু ‘সুবিধামতো পাইলে’ ধর্ষণ করে, সেক্সে রাজি না হলে, ‘মাগী দিবিনা ক্যান’ বলে ধর্ষণের পর খুনও করে ফেলে! আবার বাড়িতে সুবোধ ফুলের মতো পবিত্র চরিত্র! পারলে তাহাজুদের নামাজও পড়ে। আর সারাক্ষণ খেয়াল রাখে নিজের বোনটি যাতে কারও সঙ্গে আবার প্রেমটেম না করে। অথবা নিজের স্ত্রী যাতে হেসে কথা না বলে কোন পরপুরুষের সঙ্গে! আদালতে মিন্নির পক্ষে আইনজীবীরা না দাঁড়ানোয় ক্ষিপ্ত ছোট একটি পক্ষ মিন্নির পক্ষ নিয়েছেন। কারণ ‘সবার আইনি সহায়তা পাবার অধিকার আছে’, এই বানীতে দেশের সেরা লুটেরা-চোর-যুদ্ধাপরাধী সবার পক্ষে আইনজীবী থাকেন। ‘তাহার আড়াল’ পাণ্ডুলিপির এ পর্বে যখন মিডিয়া ব্রিফিং’এ বরগুনার পুলিশ সুপার কথা বলেন, তখন তার চেহারায় সুনাম দেবনাথের মুখ ভাসে।

প্রবাসী সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়