বাবলু ভট্টাচার্য : রাশিয়ার মেহনতী মানুষেরা মহাবিপ্লবী লেনিনের নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে প্রথম শ্রমিক-কৃষকের সোভিয়েত বা গণপঞ্চায়েতী রাষ্ট্র কায়েম করে ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে। এই অক্টোবর বিপ্লবকে রাশিয়ার যেসব কবি স্বাগত জানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট ও উচ্চভাষী ভøাদিমির মায়াকোভস্কি। মায়াকোভস্কির তার বাবা ছিলেন বন বিভাগের একজন কর্মচারী। তার বাবা খুব অল্প বয়সেই মৃত্যুকে বরণ করেন। বাবার এই অকাল মৃত্যু তাদের পরিবারে বয়ে আনে দুঃখ-বঞ্চনা। তখন রাশিয়ার বনাঞ্চল ছেড়ে মায়াকোভস্কির পরিবার মস্কো চলে যান। তার যখন পনেরো-ষোলো বছর বয়স, মায়াকোভস্কি সেই কিশোর বয়সেই শ্রমজীবী জনগণের গোপন সংগঠন ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’র লেনিন-অনুসারীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন। গোপন সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির কর্মী সন্দেহ করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দীর্ঘ এগারো মাস তাকে কাটাতে হয়েছিলো কারাগারে। কারাগার থেকে বেরিয়ে মায়াকোভস্কি ছবি আঁকার বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। রইলেনও শেষ বর্ষ পর্যন্ত। ছবি আঁকার পাশাপাশি শুরু হলো তার কবিতা লেখা। চাইলেন না তিনি গতানুগতিক ধারায় লিখতে। হলেন অভিনবত্বের সন্ধানী। কথাশিল্পী ম্যাক্সিম গোর্কি ছেলের বয়সী এই কবির কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন তিনি মায়াকোভস্কির। আর কাব্যের নৈরাজ্যিকতার মধ্যেও মায়াকোভস্কি সাম্যবাদী অন্তর্মানসকে নতুনভাবে জাগ্রত দেখতে পেয়েছিলেন গোর্কির সংস্পর্শে এসে। প্রধানত এই কারণেই মায়াকোভস্কি ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের প্রধান কবি-প্রবক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। চিত্রকর হলেন বিপ্লবী প্রাচীরপত্র আঁকিয়ে। ভবিষ্যৎবাদী পদ্ধতির কবি রূপকার হলেন গণকবি। মায়াকোভস্কি হলেন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার বৈপ্লবিক যুদ্ধের চারণ কবি। কারখানায় কারখানায় শ্রমিক জমায়েতে এবং দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে লালফৌজ জমায়েতে তিনি কবিতা আবৃত্তি করে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ কার্যেও উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন গণশক্তিকে। বড় বড় সমাবেশে আবৃত্তি করার ব্যাপারে সিদ্ধবাক, প্রচ- শক্তির অধিকারী এই যুবক কবি। তিনি আবৃত্তি করলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই তা শুনতো। জনগণ তাকে তাদের প্রিয়তম কবি বলে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন সমস্ত রকমের আমলাতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপকে জনগণ পছন্দ করতেন। সমাজতন্ত্রে যাতে আমলাতন্ত্র উৎপাত না ঘটাতে পারে সেজন্য তাগিদ দিয়ে তিনি কয়েকটি ব্যঙ্গাত্মক নাটক লেখেন। এদের একটির নাম ‘ছারপোকা।’
১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে তিনি যে ‘লেনিন’ কবিতা লেখেন, তা একদিকে যেমন প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ, তেমনি লেনিনের সমগ্র জীবনকে বুঝবার চেষ্টা। মায়াকোভস্কি বিশের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কবি-দূতরূপে ইউরোপ, আমেরিকা এবং মেক্সিকো ভ্রমণ করেছিলেন। তার কাব্যকৃতি সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় আয়তনের মধ্যে উৎসায়িত হয়েছে প্রধানত। কিন্তু আমাদের এই শতাব্দীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তরঙ্গ এসেছে অন্যান্য যে দেশেই, সেখানে তার জীবদ্দশাতেই তিনি আন্তর্জাতিক কবি-পথিকৃৎরূপে সম্মানিত হয়েছেন। মস্কোয় তিনি বিপ্লবী কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হন। বলশেভিক পার্টি ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিস্ট পার্টিতে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করেন। প্রেমে ব্যর্থতা ও পার্টি আদর্শের স্বপ্নভঙ্গে, সোভিয়েত সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী কবি আত্মহত্যা করেন বলে কথিত আছে। ১৯৩০ সালে অর্থাৎ মাত্র ৩৭ বছর বেঁচেছিলেন ভøাদিমির মায়াকোভস্কি। ভøাদিমির মায়াকোভস্কি ১৮৯৩ সালের ১৯ জুলাই সোভিয়েত রাশিয়ার জর্জিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। লেখক : চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
আপনার মতামত লিখুন :