সাইদুর রহমান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা হয় প্রেমের কবি। তার রচিত কবিতার প্রতিটি শব্দের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে প্রেম, বিরহ, ব্যাকুলতা আর নিঃসঙ্গতার এক মহা উপাখ্যান। তার রচিত অসংখ্য গান রয়েছে যার প্রতিটি শব্দ আমার আপনার মনের কথাই বলে।
আর দশজন মানুষের মত কিশোরে রবীন্দ্রনাথের জীবনেও প্রথম প্রেমের হাওয়া লেগেছিল। যার সুদূরপ্রসারি প্রভাব পড়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথম প্রেমের জোয়ার এনে দিয়েছিল ‘অন্নপূর্ণা তর্খদ’ নামে বোম্বের এক মেয়ে। বোম্বেতে থাকলেও সে একজন মারাঠি। রবীন্দ্রনাথ তার নাম দিয়েছিলেন নলিনী, নলিনী মানে প্রচুর পদ্ম জন্মে যেখানে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সতীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর অন্নপূর্ণার( নলিনী) বাবা আত্মরাম তর্খদ এর সাথে সখ্যতা ছিল। কিশোর রবীন্দ্রনাথ কে পড়ালেখার জন্য বিদেশে পাঠানোর কথা ভাবছিল তার পরিবার , সে সময় অন্নপূর্ণা ব্রিটেন থেকে মাত্র পড়ালেখা শেষ করে মাত্র দেশে ফিরেছেন। সতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাবলেন অন্নপূর্ণার সাথে থাকলে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠবেন এবং ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার ভাষা ও সংস্কৃরি সাঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন সহজেই। তাই ১৭ বছর বয়সী কিশোর রবীন্দ্রনাথ পরিবার ছেড়ে বোম্বেতে চলে গেলেন অন্নপূর্ণার কাছে ইংরেজি শিখতে। অন্নপূর্ণা ছিলেন বয়সে রবীন্দ্রনাথ থেকে তিন বছরের বড়। রবীন্দ্রনাথ অন্নপূর্ণার কাছে প্রায় দু’মাস ছিলেন। এই স্বল্প সময়ের মেলামেশাতেই তাদের দুজনের ভেতর সখ্যতা গড়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথ এবং অন্নপূর্ণা একে অপরের ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছেন,“আমার সঙ্গে সে(নলিনী) প্রয়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতে করেই সে ঘুরত আমার আনাচে কানাচে, আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিত সান্তনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে গভীর প্রভাব পড়েছিল এই প্রেমের। কিন্তু তাদের ভেতরে চলমান অসম প্রেমের এই গল্প সফল পরিণতি পায় নাই। তাদের মেলামেশার গভীরতার কারণে আত্মারাম এবং সতীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন তাদের বিয়ে দিয়ে দিবেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বাবা এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না কারণ, রবীন্দ্রনাথের তখন বয়স কম এবং রবীন্দ্রনাথকে আরো পড়াশুনা করাবেন। ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ অন্নপূর্ণা তথা নলিনীকে ছেড়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে গমনের দুই বছর পর অন্নপূর্ণার বিয়ে হয়ে যায় হ্যারল্ড লিটলডেল নামে একজন স্কটিশের সঙ্গে। বিয়ের পর অন্নপূর্ণা স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানেই এডিনবার্গে বসবাস শুরু করেন। ১৮৯১ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে অন্নপূর্ণা মারা যান।
রবীন্দ্রনাথ আর নলিনীর প্রেমের সম্পর্ক শুধু সাময়িক আকর্ষণ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের রচিত বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে সেটা ফুটে উঠেছে। বিভিন্ন কবিতায় নলিনীকে রুপায়িত করেছেন অত্যন্ত সযত্নে, ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের ভালোবাসা আর বিরহের নীরব গল্প। রবীন্দ্রনাথ একটি গদ্য নাটক রচনা করেন ‘নলিনী’ নামে। নলিনীও এই অসম প্রেমকে স্মরনীয় করে রাখতে চেয়েছেন সর্বদা। তাদের প্রেমের অনুভৃতি ছিল জীবনভর। নলিনীকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান শুনে নলিনী বলেছিলেন, “ রবীন্দ্রনাথ, তোমার গান শুনে মনে হচ্ছে , আমার মৃত্যুশয্যার পাশে এই গান শোনানো হলে আমি আবার জীবন ফিরে পাব।”
প্রথম যৌবনে নিবেদিত তরুণীর প্রেম উপলদ্ধি হয় রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনেও এবং তার প্রতি নিজের আকর্ষণও আবিষ্কৃত হয় বিগত যৌবনে। জীবনের শেষ সময়ে এসে রবীন্দ্রনাথ আবার নলিনীকে স্মরণ করেছেন,বউঠাকুরান কদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের সুপারি কাটা হাতের গুণ ছাড়া অন্য কিছুর প্রশংসা করতেন না, এমনকি চেহারারও খুঁত ধরে বিধাতার উপর রাগ ধরিয়ে দিতেন। কিন্ত এই তরুণীর মুখে তিনি প্রথম শুনেছিলেন তার চেহারার প্রশংসা। নলিনী একবার রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন,“একটা কথা আমার রাখতেই হবে তুমি কোনদিন দাড়ি রেখ না, তোমার মুখের সীমানা যেন কিছুতেই ঢাকা না পড়ে”। ৮০ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ লিখেন, “ সবাই জানে, আমি তার কথা রাখিনি। কিন্তু তার কথা যে রাখা হয়নি , এটা দেখার জন্য সে আর বেঁচে নেই”।