আদিল আহনাফ : আজ আমাদের দেশ অপকর্মের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে৷ নৈতিক অবক্ষয় এবং সার্বিক অপকর্ষতায় পৃথিবীর শীর্ষে চলে যাচ্ছে৷ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি ইত্যাদি সব অপকর্ম আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ধর্ষণ৷ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে সর্বত্র এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে৷ ছেলে-যুবক, পৌড়-বৃদ্ধ সকলেই যেন দিনে দিনে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে৷ বিশেষত যুব সমাজ উন্মুক্তভাবে ধর্ষণের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে৷ আর এই ঘৃণ্যতম অপরাধ করতে তাদের ন্যূনতম ভয়ও কাজ করছে না৷
অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, এখন এই অপরাধ-অপকর্ম প্রভাব বিস্তার করেছে স্কুল-কলেজ, মাদরাসা বিশেষ করে মহিলা মাদরাসায়ও৷ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির করা হচ্ছে৷ কাউকে ভয় দেখিয়ে, কাউকে বা ছলে-বলে-কৌশলে ব্ল্যাকমেল করে অথবা কাউকে জোর জবরদস্তি করে অপকর্ম করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র শিক্ষক এমনকি অধ্যক্ষ পর্যন্ত৷ বাকি নেই সাধারণ কেয়ারটেকারও৷
সুদীর্ঘ আড়াইশো বছরের গৌরবময় কওমি মাদরাসা৷ যে কওমি মাদরাসা এই উপমহাদেশে ইসলামের জ্ঞান চর্চায় শুদ্ধতার প্রতীক৷ মুসলিম সভ্যতার গৌরব৷ সেই কওমি মাদরাসায় এখন চর্চিত হচ্ছে ধর্ষণের মতো নির্লজ্জতম অপরাধ৷ দিনে দিনে মানুষের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মাদরাসার প্রতি আস্থা৷ ভেঙে পড়ছে তাদের বিশ্বাসের দেয়াল৷ এবং কওমি মাদরাসা যেন হারাতে বসেছে সুদীর্ঘকালের জ্বলজ্বলে ঐতিহ্য৷
যে কওমি মাদরাসায় দ্বীনের গভীরতম জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়৷ দ্বীন কি জিনিস, দ্বীনের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সবক দেয়া হয়, সেই মাদরাসায় যদি এ ধরনের অপকর্ম সংঘটিত হয় তাহলে আসলে মুখ দেখানোর উপায় থাকে না৷ মাথায় টুপি পরে সমাজে এখন চলতে কেমন যেন হীনম্মন্যতা অনুভব হয়৷ আর এমনটি হলে সাধারণ মানুষ আস্থা রাখবেই বা কিভাবে? ভাবা যায় কোথায় গিয়ে পৌঁছেছি আমরা? কী ভয়ঙ্কর স্রোতধারা চালু হয়েছে কওমি মাদ্রাসায়?
গত শুক্রবার (৫ই জুলাই) নয়া দিগন্তের নিউজে বলা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ এক মহিলা মাদরাসার অধ্যক্ষ ১২ জন শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করেছে৷ এবং এটি ধামাচাপা দিতে কুরআন ছুঁয়ে শপথও করাতো বলে জবানবন্দিতে সে বলেছে৷ এছাড়া আরো বিভিন্ন মহিলা মাদ্রাসায় এসব অপকর্ম অধুনা দেখা যাচ্ছে৷ আগে যে ছিল না তা নয়; বরং এখন যেন মহামারী আকার ধারণ করেছে৷ এবং কিছুদিন আগে নোয়াখালীর সোনাগাজীতে আলিয়া মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত কে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ নুসরাত প্রতিবাদ করলে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ দুঃখজনকভাবে তার সহপাঠিনীরাই তাকে হত্যা করেছে ধর্ষকের পক্ষাবলম্বন করে৷ তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একই সাথে যেমন অপরাধী বাড়ছে ঠিক তেমনিভাবে অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়ার লোকও কিন্তু তৈরি হয়েছে এক কথায় আমাদের নৈতিক অধঃপতন যেন সীমা ছাড়িয়েছে৷
গত ৮ এপ্রিল যাত্রাবাড়ীতে এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়ে থানায় পুলিশের কাছে মামলা করতে গেলে আবার ধর্ষণের শিকার হয়৷ গত ৭ ই জুলাই সেই যাত্রাবাড়ী এলাকায়ই সাত বছরের শিশু সায়মাকে তাদের বাসার ছাদে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়েছে৷ গত ৫ ই জুলাই নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ করা হয়েছে৷ এরকম আরো অসংখ্য ধর্ষণের খবর প্রতিনিয়ত পত্র-পত্রিকায় আসছে৷
দৈনিক নয়াদিগন্তের নিউজ থেকে জানা গেছে, গত বছরের প্রথম ছয় মাসের চেয়ে এ বছরের প্রথম ছয় মাসের ধর্ষণ অনেক বেড়েছে৷ এই বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছে গত বছরের তুলনায় শতাধিক৷ গত বছরের প্রথম ৬ মাসে মোট ৪২৭ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ আর এই বছরের প্রথম ৬ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৬৩০ জন৷ অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর ২১৩ জন বেশি ধর্ষিত হয়েছে৷ যা গড় তুলনায় প্রতিদিন অন্তত তিনজন করে বেড়েছে৷ একই সাথে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে এমন রয়েছেন ১০৫ জন৷ ৭ জন ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪১ জনকে৷ এর মধ্যে ১০৪ জন শিশু রয়েছে৷ এখানে জানিয়ে রাখা যায় যে, এটা কেবল দৈনিক পত্রিকায় তথা মিডিয়ায় আশা তথ্য সংখ্যা আর মিডিয়ার অগোচরে আরও কত শত ধর্ষণ যে হয়েছে তার তো ইয়ত্তা নেই৷
শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যা সম্পর্কে আরেকটি তথ্য: ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রথম ৫ মাসে ৪৭৯ জন নারী- শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ৭ জন শিশু৷ ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৩২৮ টি৷ ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫০ জন৷ ৭-১২ বছর বয়সী ৭৬ জন৷ এবং ১৩-১৮ বছর বয়সী ৭৮ জন৷ ১৯-৩০ বছর বয়সী ৫১ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ ধর্ষণের শিকার ২১৪ জনের বয়স নির্ণয় করা যায়নি৷ ধর্ষণের পর ১৮ বছরের কম বয়সী ১৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে৷ অর্থাৎ হিসাব মতে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৮১ শতাংশই শিশু যা রীতিমত আমাদের টনক নাড়িয়ে দেয়৷
প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা ভয়ঙ্কর এই অপরাধ তথা ধর্ষণ প্রতিরোধে দ্রুততম সময়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ সরকারিভাবে কঠোরভাবে ধর্ষণ প্রতিরোধ লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন এখন সময় দাবি৷ অপরাধ আর কতদূর এগুলো আমরা সচেতন হব? এবং আগামী প্রজন্ম সুস্থ সুন্দর ও সভ্য সমাজ পাবে?
ধর্ষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে আমরাও কিছু প্রস্তাবনা গ্রহণ করতে পারি
১. যে কোনো শিক্ষার্থী স্থানে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার আগে তার নৈতিকতা সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ৷
২. যৌন উস্কানি মূলক চলচ্চিত্র রিলিজ বন্ধ করা
৩. পার্ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং যেকোনো বিনোদন কেন্দ্রে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করা৷
৪. বিয়ে বহির্ভূত অবৈধ প্রেম ভালোবাসা থেকে সামাজিকভাবে সচেতনতা অতি অবশ্যই অবলম্বন করা৷
৫. অনতিবিলম্বে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হোক৷
মহিলা মাদরসায় ধর্ষণ বন্ধের ব্যাপারে কিছু প্রস্তাবনা
১. সারা দেশের আলেমদের সম্মিলিত বৈঠকের মাধ্যমে মহিলা মাদ্রাসা থেকে পুরুষ শিক্ষক নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হোক৷
২. পুরুষ পরিচালক রাখা যেতে পারে তবে তিনি মাদ্রাসার আভ্যন্তরে কোন কামরায় অবস্থান করতে পারবেন না৷
৩. প্রতিটি মহিলা মাদ্রাসায় মহিলা শিক্ষিকার মাধ্যমে পাঠদান করা৷
উপরোল্লিখিত প্রস্তাবনাগুলো এবং দেশের সুশীল সমাজ এর মাধ্যমে কার্যকরী আরো কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক৷ এটা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আশা করি ধর্ষণের মতো জঘন্যতম একটি অপরাধের টুটি আমরা চেপে ধরতে পারবো৷ এভাবে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে ধর্ষণ পুরোপুরি নির্মূলের এগিয়ে যেতে পারব৷ ইনশাল্লাহ৷ (সূত্র : শীলনবাংলা)