স্বপ্না চক্রবর্তী : পাস্তুরিত তরল দুধে ক্ষতিকর জীবাণু থাকে না, কিন্তু অ্যান্টিবায়েটিক পাওয়া যেতে পারে- বিশেষজ্ঞরা এই দাবি করলেও বিষয়টি নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে দেশের দুই শীর্ষ প্রতিষ্ঠান।
খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) বলছে, বিএসটিআইয়ের মান পরীক্ষার তালিকায় অ্যান্টিবায়েটিক পরীক্ষা নেই। কিন্তু মানবস্বাস্থ্যের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মান পরীক্ষা কেন বিএসটিআইয়ের পরীক্ষার তালিকায় থাকবে না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি বলছেন, ‘তাদের রিপোর্টে কি সমস্যা আছে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমার এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। ’
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরল দুধ পাস্তুরিত করা হলে এর জীবাণু তো ধ্বংস হয়। কিন্তু পাস্তুরাইজেশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়েটিক ধ্বংস করার ক্ষমতা কোনো কোম্পানিরই নেই। তাই খামারি পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করে গরুকে যখন অ্যান্টিবায়েটিক দেওয়া হবে, তখনকার দুধ কোম্পানিগুলোকে না দিয়ে ধ্বংস করে দিতে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।
বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক মো. রিয়াজুল হক বলেন, ‘আমরা যখন একটি পণ্যের মান পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করি, তখন সম্পূর্ণরূপে ফ্রিজিং অবস্থায় পরীক্ষাগারে নিয়ে আসা হয়। বিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগার আন্তর্জাতিকভাবে অ্যাক্রিডেটেড। এই পরীক্ষাগারের মান পরীক্ষা নিয়ে কোনো দ্বিমত কারো নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ করে কেন এ রকম একটি পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো, তা তারাই ভালো বলতে পারবে। আর কোথা থেকে কিভাবে তারা নমুনা পণ্য সংগ্রহ করেছে, তাও আমাদের জানা নেই। তাই আমরা মনে করি, নিয়মের বাইরে গিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পরীক্ষা করেছে।’
জবাবে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘বিএসটিআইয়ের মান পরীক্ষার তালিকায়ই অ্যান্টিবায়েটিক পরীক্ষা নেই। কিন্তু আমাদের কাছে অ্যান্টিবায়েটিক জরুরি একটি বিষয় বেঁচে থাকার জন্য। দুধের সাতটি নমুনার মধ্যে সবগুলোতেই আমরা মানবচিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়েটিক লেভোফ্লক্সসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এজিথ্রোমাইসিনসহ ডিটারজেন্ট, ফরমালিন, অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছে। যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। নির্ধারিত ফ্যাটের মাত্রাও ঠিক নেই। টোটাল ব্যাকটেরিয়া কাউন্ট ও কলিফর্ম কাউন্ট ছিলো পাস্তুরিত দুধের সবগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। অথচ আমাদের সংবাদ সম্মেলনের পর পরই সন্ধ্যায় বিএসটিআই বাজারের ১৫টি দুধের নমুনা পরীক্ষা করে হাইকোর্টকে জানিয়েছে, তারা কোনো দুধে কোনো ক্ষতিকর কিছু পায়নি। এটি কিভাবে সম্ভব হলো, তা বিএসটিআই বলতে পারবে। আমরা আমাদের কাজ করেছি। যথেষ্ট আর্থিক সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে মানবসেবা নিশ্চিতে পরীক্ষাগুলো করেছি। এখন বিএসটিআইয়ের প্রতি যদি সাধারণ মানুষের দরদ বেশি থাকে, তাহলে তারা বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রিত পণ্যই কিনবে। আমাদের কিছু বলার নেই।’
এদিকে শীর্ষ দুই প্রতিষ্ঠানের মান পরীক্ষা নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। কোন পণ্য মানউত্তীর্ণ আর কোন পণ্য নিম্নমানের, এ বিষয়ে তৈরি হয়েছে দ্বিধাও। বিশেষ করে নগরবাসীর নিত্যভোগ্য পাস্তুরিত তরল দুধ নিয়ে বিএসটিআই ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের পাল্টাপাল্টি প্রতিবেদনে মঙ্গলবার থেকে রাজধানীতে আড়ংসহ বিভিন্ন নামী-দামি কোম্পানির পাস্তুরিত তরল দুধ বিক্রি কমে গেছে বলে জানাচ্ছেন বিক্রেতারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর থেকে উত্তরণে খামারি পর্যায়ে সচেতনতার বিকল্প নেই। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আব্দুন নুর তুষার বলেন, প্রাণী চিকিৎসকরা প্রাণীর চিকিৎসা করতে প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়েটিক দেন। এটা বন্ধ করতে চাইলে এটাও মানতে হবে যে, প্রচুর গরু অসুখে মরবে। যেটা করা যেতে পারে সেটা হল, গরুর শরীরে অ্যান্টিবায়েটিক চলাকালে দুধ বিক্রি বা সংগ্রহ করে মিল্ক ভিটা বা প্রাণের মতো কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করা যাবে না।
তিনি বলেন, ‘ডিটারজেন্ট দিয়ে খামারি তার দুধের পাত্র ধোন। সাধারণত এক্ষেত্রে তারা খুব বেশি পানির ব্যবহার করেন না। তারা সাবান মিশ্রিত চৌবাচ্চায় পাত্রটি ডোবান এবং একবার ধুয়ে নেন। এতে করে পাত্রে ডিটারজেন্ট থেকে যায়। আমি মনে করি, দুধে ওষুধ ও ডিটারজেন্ট পাওয়ার দায় খামারিদের। কারণ তিনি জানেন, কোন গরুকে ওষুধ দিচ্ছেন। তিনি কম পানিতে পাত্র পরিস্কার করছেন।’ ‘যেহেতু অ্যান্টিবায়েটিক টেস্ট করা সময়াসাপেক্ষ ব্যাপার এবং কারখানার গেটে এটা করা সম্ভব নয়, সেহেতু কোম্পানিগুলোর উচিৎ, খামারিদের সচেতনতা তৈরিতে কাজ শুরু করা। একই ধরনের অ্যান্টিবায়েটিক মাছ ও মুরগিতেও পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, চাষ করা মাছ , মুরগিতে প্রচুর ওষুধ ব্যবহার করা হয়, এমনকি হরমোনও। দুধে তবু এক লিটার পরীক্ষা করে এক হাজার লিটারের বিষয়ে বোঝা সম্ভব। শতভাগ সঠিক হতে হলে মাছ ও মুরগিতে একটি একটি করে পরীক্ষা করতে হবে। সেটা আরো কঠিন। তাই এক্ষেত্রে খামারিরা সচেতন না হলে আমরা বিপদেই থাকবো।’
তুষার বলেন, ‘যেসব উপাদান দুধে উপস্থিতির কথা ঢাবির গবেষকরা বলেছেন, সেগুলো মানবদেহের জন্য চরম হুমকি। যেমন অ্যান্টিবায়েটিকগুলো রোগের উপস্থিতি ছাড়া শরীরে প্রবেশ করে, তার সঠিক ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না। ফলে এগুলো খুব শক্তিশালী আকার ধারণ করে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই অ্যান্টিবায়েটিক সংশ্লিষ্ট রোগের আক্রমণ হলে ওষুধটি খেলেও রোগ নিরাময়ে আর কাজ করবে না। তাই সচেতনতা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে এখন আজ থেকেই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে পরিচালিত গুণগত মান পরীক্ষায় ব্যবহৃত দুধের সাতটি নমুনা হলো মিল্কভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, প্রাণ, ইগলু, ইগলু চকোলেট ও ইগলু ম্যাংগো।
বিষয়টি নিয়ে এখনি মুখ খুলতে নারাজ বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এস এম ইসাহাক আলী। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি বলছে না বলছে সেটা তাদের বিষয়। সেটা আমাদের মাথাব্যথা নয়। আমরা আমাদের কাজটা করে যাচ্ছি। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। তাই আমরা যা বলার আদালতেই বলবো।’ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়