শাওন মাহমুদ : সুমন ভাই কখনো নিজের বাবার নাম বলতেন না। দেখা করেননি কখনো। অত্যাচারী স্বামীকে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন ছেড়েছিলেন সুমন ভাই ছোট থাকতেই। প্রকাশনী আর লেখালেখি করে যা আয় হতো তাতেই ছেলেকে নিয়ে জীবনযাপন করতেন। তাই তার কাছে মা ছিলো সব। রায়ের বাজার বদ্ধভূমি থেকে মাকে সনাক্ত করেছিলেন তিনি। তখন তার বয়স ছিলো আট বছর। মা চলে যাওয়ার পর এতিমখানা, মাদ্রাসা আর মামার বাড়ি এসবই ছিলো সুমন ভাইয়ের ঠিকানা। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর জীবনের তাগিদে অটো চালিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছিলেন। ছোটখাটো চাকরি করে জীবন চালিয়েছিলেন।
আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি ঘ্যাঁনঘ্যাঁনানী স্বভাবের ছিলেন তিনি। বিরক্ত করতেন সব সময়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, শহীদদের নিয়ে, রাজাকার নিয়ে তার কথা শেষ হতো না। যুদ্ধাপরাধী বিচার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন অনেকের চেয়ে বেশি। শহীদ মিনার, বদ্ধভূমি অথবা স্মৃতিসৌধে সুমন ভাইকে লাল সবুজ জামায় দেখা যেতো। হাতে থাকতো বাংলাদেশের পতাকা। মোটরবাইক চালাতেন তিনি। আমাদের কারো বাড়ি যেতে সমস্যা হলে নিজেই নামিয়ে দিয়ে যেতেন।
সুমন ভাইয়ের মোটরবাইকের পেছনে শেষ চড়েছি রায়ের বাজার বদ্ধভূমি থেকে আমার বাসা পর্যন্ত। রাস্তায় নেমে কোকাকোলা আর প্যাটিস খাইয়েছিলেন। ব্যাগে হাত দিতে দেননি আমাকে। খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করা সময়েও তিনি বেঁচে ছিলেন। চাকরি না থাকার সময়েও তিনি বেঁচে ছিলেন। নীরবে মায়ের জন্য কাজ করার সময়েও তিনি বেঁচে ছিলেন। একা একা বড় হওয়ার সময়ও বেঁচে ছিলেন। তার মৃত্যুকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়েছে। তদন্ত করে সঠিক উত্তর না পেলেও, সুমন ভাই চলে গিয়েছেন তার গন্তব্যে।
শহীদের সন্তানেরা আত্মহত্যা করে না। শত লাঞ্চনায় তারা বেঁচে থাকতে চায়, তাদের পিতামাতার রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের মাটিতে। আঁকড়ে ধরে বসে থাকতে চায় লাল-সবুজের পতাকা। একজন শহীদ সন্তান জানে আরেক শহীদ সন্তানের বুকের বেদনার ভার। অপমানে উপেক্ষাকে উড়িয়ে দিয়ে বুক চিতিয়ে বেঁচে থাকতে তারা একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়। শত্রুরা জানে এই একত্রীভূত অসীম শক্তির কথা। আপনারা জানেন না। সুমন ভাইয়ের এইভাবে চলে যাওয়া আর সবাই মেনে নিলেও, আমি কখনো মেনে নিতে পারবো না। গত বছর ১৪ জুন বছর সুমন ভাইয়ের গলাকাটা লাশ পাওয়া গিয়েছিলো। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :