ডেস্ক রিপোর্ট : বোরো মৌসুমে ধানের দাম কম হওয়ায় চাষের জন্য ধানের বীজ ক্রয়ে কৃষকের অনাগ্রহ ছিলো। তাই বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বীজ বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এক দফায় দাম কমানোর পরেও ৫৯ দশমিক ১৪ টন বীজ অবিক্রীত রয়ে গেছে, যা পরের ২০১৯-২০ মৌসুমে বিক্রির জন্য তারা গুদামে রেখেছেন। সমকাল
গত ৩০ মে বিএডিসির পক্ষ থেকে কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির তৃতীয় বৈঠকে এক লিখিত প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। কমিটির সদস্য সরকারদলীয় এমপি আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, বিএডিসির বীজ কেন অবিক্রিত রয়েছে, এ বিষয়ে তিনি কমিটির আগের বৈঠকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ বৈঠকে এই তথ্য দিয়েছে বিএডিসি। তবে সে বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। যদিও তিনি মনে করেন, বিএডিসির দেওয়া এই ব্যাখ্যা সঠিক নয়। কারণ চাষিদের মধ্যে এই বীজ কেনায় আগ্রহ রয়েছে। ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে বলেই বিএডিসির বীজ অবিক্রিত থেকেছে।
তিনি আরও বলেন, এবারেও ধানের দর কম। তাই বলে কৃষকদের বীজ ক্রয়ে আগ্রহ থাকবে না, এমন আশঙ্কা নেই। একজন চাষি রাতারাতি তার ফসল ফলানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না। এক বছরের একজন ধানচাষি পরের বছরেই তিনি পাটচাষি হয়ে যেতে পারেন না।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, ৩০ মে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএডিসির চেয়ারম্যান ফজলে এলাহীকে এই ইস্যুতে তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। কমিটির সভাপতি মতিয়া চৌধুরী ও সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক তার কাছে কৈফিয়ত চান- কেন অতিরিক্ত বীজ ক্রয় করা হয়েছে। সরকারের বরাদ্দ আছে বলেই খরচ করতে হবে- বিএডিসির চেয়ারম্যানকে এই মানসিকতা পরিবর্তনেরও পরামর্শ দেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন বলেন, বীজ বিক্রি না হওয়া প্রসঙ্গে বিএডিসির চেয়ারম্যান যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে কমিটির কেউই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাদের বলা হয়েছে, অতিরিক্ত বীজ সংগ্রহ না করার জন্য। বিশেষ করে 'ব্রি ধান ২৮' জাত ক্রমশই কৃষকদের কাছে অজনপ্রিয় হয়ে পড়ছে। তাই যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু বীজ সংগ্রহ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে এই জাতের ধানের বীজ বিক্রি না করার দিকে যেতে হবে।
তবে মাঠ পর্যায়ের কৃষক ও বিএডিসির বীজ বিক্রির জন্য নির্ধারিত ডিলারদের অভিযোগ ভিন্ন। তারা বলছেন, বোরো ধানসহ গত মৌসুমে বিভিন্ন রবিশস্য ও সবজি বীজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল বিএডিসি। তাদের নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় খোলা বাজারে এসব ফসলের বীজের মূল্য অনেক কম ছিল। বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানির বীজ বেশি বিক্রি হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতেই তারা দাম বাড়ানোর মতো কারসাজি করেছে। যদিও পরে বিএডিসি বীজের দাম পুনর্নির্ধারণ করেছিল।
এসব অভিযোগ লিখিতভাবে গত বছরের অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ডিলাররা বিএডিসির চেয়ারম্যানের কাছে তুলে ধরে দাম কমানোর দাবি জানিয়েছিলেন। ডিলার ও মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের লিখিত ওই অভিযোগে দেখা যায়, ওই সময়ে বিএডিসি ধানবীজের দাম নির্ধারণ করেছিল ৫০ টাকা কেজি। অথচ খোলা বাজারে তখন খাবার ধান ১৭ টাকা কেজি। গমবীজের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৬ টাকা কেজি; খোলা বাজারে খাবার গম তখন ছিল ২০ টাকা কেজি। 'এ গ্রেড' আলুবীজের দাম ৩০ টাকা আর 'বি গ্রেড' আলুবীজের দাম নির্ধারণ ছিল ২৮ টাকা কেজি। অথচ খাবার আলু তখন বাজারে দাম ছিল ১৬ থেকে ১৭ টাকা কেজি। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর বিএডিসি বীজ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের পরিচালক আতাউর রহমান বিএডিসির চেয়ারম্যানের কাছে বীজের দাম কমানোর দাবিতে লিখিত আবেদনেও এসব মূল্য উল্লেখ রয়েছে। ওই আবেদনে ধানবীজ ৩৫, গমবীজ ৩৫ এবং আলুবীজ ২০ ও ২২ টাকা কেজি নির্ধারণের দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে সংসদীয় কমিটির বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে (বীজ বিতরণ বর্ষে) বিএডিসির উৎপাদিত বিভিন্ন ফসলের মোট এক লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৭ টন বীজ বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৯৬ হাজার ৫১৬ টন বীজ মৌসুমের প্রথম পর্যায়ের নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হয়। মৌসুমের শেষ পর্যায়ে পুনর্নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে ৩৯ হাজার ৯৪৯ টন বীজ। ৭৯১ টন বীজ পরের মৌসুমে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই ৭৩৭ টন বোরো বীজ রূপান্তরিত আউশ বীজ হিসেবে বিক্রি হয়েছে। বাকি ৫৯ টন পরের মৌসুমে বিক্রির জন্য গুদামে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, সিড প্রমোশন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিএডিসি বীজ উৎপাদন করছে। চলতি বছরে বিতরণযোগ্য বীজও সে অনুযায়ী উৎপাদন করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বীজ বিক্রি পরবর্তী পর্যালোচনা সভার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, চলতি বছরে বোরো মৌসুমে ধানের দর কম থাকায় চাষিরা আগের বছরের তুলনায় ধানবীজ ক্রয়ে অনাগ্রহী ছিলেন। একই সঙ্গে ব্লাস্ট রোগ সংক্রমণের আশঙ্কায় ব্রি ধান-২৮ চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হয়। গমেও ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ায় এবং ভুট্টার আবাদ বেড়ে যাওয়ায় গমবীজ বিক্রি কম হয়েছে।
তবে বিএডিসির এই ব্যাখ্যাকে অসত্য মন্তব্য করে কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, এখন ধানের বাজার দর কম হলেও গত মৌসুমে এই পরিস্থিতি ছিল না। এখানে বিএডিসির ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে বলেই বীজ অবিক্রীত থেকে গেছে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই তারা এই ব্যাখ্যা হাজির করছে। তাদের কর্মকর্তারা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তার মতে, আগামী মৌসুমে বীজ বিক্রির জন্য এখন থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বিএডিসির।
আবদুল মান্নান আরও বলেন, এবার ধানের উৎপাদন বেশি হয়েছে। এটা আরও বাড়াতে হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। পাশাপাশি কৃষককে ধানের ন্যায্য মূল্য দিতে পথ বের করতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কাঁচা ধান কিনে সরকার নিজেই শুকিয়ে পড়ে চাল করছে। তবে আমাদের গুদাম সুবিধা কম। আগে ১৪ লাখ টন পর্যন্ত ছিল, এখন ২০ লাখ টন পর্যন্ত পৌঁছেছে।
আপনার মতামত লিখুন :