নিউজ ডেস্ক: ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেলাল, তার দুই ভাতিজা আজিজ ও লিটন এবং ভাগনে আহমদ হোসেন প্রায় পাঁচ মাস আগে এক সঙ্গে দেশ ছেড়েছিলেন। সূত্র: দেশ রূপান্তর
ভারত, শ্রীলংকা, কাতার, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ঘুরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে তারা নৌকায় উঠেছিলেন। সাগর পার হলেই ওপারে স্বপ্নের দেশ ইতালি। তাই মনের সব ভয় এবং দালালদের নির্যাতন-প্রতারণাকে উপেক্ষা করেই নৌকায় চড়েছিলেন তারা। কিন্তু যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরই ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি যাত্রীবাহী নৌকাটি ডুবে যায়। নৌকার ৮৫ যাত্রীর বেশির ভাগই ছিলেন সিলেট অঞ্চলের। একে অন্যের পরিচিত। অনেকে আবার পরস্পর আত্মীয়।
নৌকাডুবির পর তাদের বুকফাটা আর্তনাদ সাগরের বুকে কান্নার ঢেউ হয়ে ভেসেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা বরফশীতল পানিতে সাঁতার কেটে, উল্টে যাওয়া নৌকা আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন।
শেষ পর্যন্ত ৮৫ যাত্রীর ১৪ জনের জীবন রক্ষা হয়। বাকিরা চিরতরে ডুবে যান গভীর সাগরে। বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবানদের একজন হলেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মোহিতপুর গ্রামের মৃত তজমুল আলীর ছেলে বেলাল আহমদ।
তার দুই ভাতিজা আবদুল আজিজ ও লিটন আহমদ এবং ভাগনে আহমদ হোসেন চোখের সামনেই, তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একপর্যায়ে জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে সাগরে হারিয়ে গেছেন।
ভাগ্যবান বেলাল শুক্রবার দেশে ফেরেন। সাগরে ডুবে মারা যাওয়া ভাগনা ও ভাতিজাদের ‘শিরনি’র গরু কিনতে সোমবার বেলাল এসেছিলেন সিলেট নগরীর কাজিরবাজারে।
সেখানেই তিনি একান্তে কথা বলেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। জানান ভীতিকর সেই অভিজ্ঞতার কথা।
বেলাল বলেন, ‘বেঁচে আছি এ কথা এখনো বিশ্বাস করতে পারি না। প্রতিনিয়ত সেই মৃত্যুর মিছিল তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। রাতে ঘুমাতে পারি না’।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বেলাল বলেন, ‘আমার পাশ থেকেই ভাগনে ও ভাতিজারা দুনিয়া থেকে চলে গেল। আমি কীভাবে বাঁচলাম জানি না। আল্লাহ আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।’
বেলাল জানান, সিলেট নগরীর জল্লারপাড়ের রাজা ম্যানসনের নিউ ইয়াহইয়া ওভারসিজের মালিক এনামুল হকের সঙ্গে জনপ্রতি আট লাখ টাকায় তিনি, তার দুই ভাতিজা ও এক ভাগনে ইতালি যাওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন।
তাদের বিমানের ফ্লাইটে ইতালি পৌঁছানোর কথা ছিল। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর তারা ইতালির উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। তাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া ভারতে। সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে কাতারে পৌঁছান। এরপর তিউনিসিয়া ঘুরে তারা লিবিয়ায় পৌঁছান। লিবিয়ায় যাওয়ার পর তার টের পান আকাশপথে নয়, তাদের সাগরপথেই ইতালি পৌঁছানোর চেষ্টা করবে দালালচক্র।
তিনি জানান, তখন দালালদের সঙ্গে তাদের দেনদরবার হলেও তারা ছিলেন অসহায়। লিবিয়ায় তাদের একটি ঘরে বন্দী রাখা হতো। সেখানে ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশী আরো অনেকে ছিলেন।
বেলাল বলেন, বাংলাদেশি দালালচক্রের লিবিয়ার এজেন্টরা তাদের ঠিকমতো খাবার দিত না। কারণে-অকারণে মারধর করত। লিবিয়ার মিসরাতার একটি ঘরে তাদের বন্দী রেখে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা আদায় করে এনামুল হক।
‘এরপর ত্রিপোলিতে পৌঁছার পর আদায় করে বাকি তিন লাখ টাকা। পুরো আট লাখ টাকা পরিশোধের পরও ত্রিপোলিতে একটি ঘরে প্রায় আড়াই মাস বন্দী করে রাখা হয়’।
বেলাল জানান, ত্রিপোলি থেকে তাদের জোয়ারায় নিয়ে লিবিয়ানদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেখানে ইতালি যাত্রার উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া ৮২ বাংলাদেশির পাশাপাশি আফ্রিকার কিছু লোক ছিলেন। এরপর গত ৮ মে রাত ৩টার দিকে লিবিয়ানরা তাদের জোর করে বনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে কয়েক কিলোমিটার পায়ে হাঁটিয়ে সাগরপাড়ে নিয়ে যায়।
বেলাল বলেন, ‘সাগরপাড়ে নিয়ে আমাদের তিনটি ছোট ছোট নৌকায় তোলা হয়। সেগুলো ঘণ্টাখানেক চলার পর মাঝসাগরে নিয়ে বড় জাহাজে তোলা হয়। যে তিনটি ছোট নৌকায় আমরা এসেছিলাম তার একটি নিয়ে লিবিয়ানরা ফিরে যায় এবং বাকি দুইটি ছোট নৌকা জাহাজের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। ৯ মে সকাল ৭টার দিকে আমাদের জানানো হয়, আমরা ইতালির কাছাকাছি চলে এসেছি। এবার ছোট নৌকায় যেতে হবে।’
বেলাল জানান, তখন অনেকে ছোট নৌকায় যেতে আপত্তি জানালেও তাদের ভয় দেখিয়ে নৌকায় উঠতে বাধ্য করা হয়। ৩০-৩৫ জন ধারণ ক্ষমতার নৌকায় দ্বিগুণ যাত্রী তোলা হয়।
বেলাল বলেন, ‘আমি, আমার ভাতিজা ও ভাগনেসহ সিলেটের আরো অনেক যাত্রী যে নৌকায় উঠেছিলাম সেটিতে সম্ভবত ৮০-৮৫ জন যাত্রী ছিল। নৌকাটি কয়েক মিনিট চলার পরই উল্টে যায়। এরপর আমরা সাগরে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকি। এ সময় লিবিয়ান পাচারকারীরা নৌকা ডুবে যাওয়ার বিষয়টি দেখলেও তারা আমাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। উল্টে যাওয়া নৌকা আঁকড়ে আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। এ সময় ঠান্ডায় অনেকে অবশ হয়ে তলিয়ে যান। অনেককে বড় বড় মাছ টেনে নিয়ে গেছে বলেও জানান বেলাল।
নিজের শরীরে মাছের একাধিক কামড়ের চিহ্ন দেখিয়ে বেলাল বলেন, ‘প্রায় ১১ ঘণ্টা পর তিউনিসিয়ার একটি মাছ ধরা নৌকা আমাদের কাছে আসায় আমরা ১৪ জনের জীবন রক্ষা হয়েছে।’
বেলাল বলেন, দালালদের খপ্পরে পড়ে এভাবে ইউরোপযাত্রার চিন্তা যেন আর কেউ না করে। পাশাপাশি দেশের তরুণ-যুবকদের সাগরে ডুবিয়ে মারার সঙ্গে জড়িত দালাল চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন ভাগ্যক্রমে নতুন জীবন পাওয়া বেলাল আহমদ।