শাহীন চৌধুরী: দেশের জ্বালানি সংকটের কারনে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি আমদানি করছে। কিন্তু তারপরও গ্যাস চুরি বন্ধ হয়নি। বরং নানাভাবে বেড়েই চলেছে গ্যাস চুরি। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের তথ্য মতে, এখনো বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার গ্যাস চুরি হয়।
রাজধানীসহ সারাদেশেই গ্যাস চুরি বাড়ছে। তবে ঢাকা, নারায়াণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লায় চুরি হচ্ছে বেশি। সংশ্নিষ্টদের মতে, দৈনিক প্রায় ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হয়। তারা বলছেন, রাজধানীর আশপাশের অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দৈনিক অন্তত ১৫ কোটি গ্যাস চুরি রোধ করা সম্ভব। ক্যাবের উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলমের মতে, শুধু অবৈধ সংযোগের কারণে বছরে ১২শ' কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্প্রতি তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি নিয়ে একটি প্রতিবেদন জ্বালানি বিভাগে জমা দিয়েছে। এতে গ্যাস চুরির বিষয়টি বিশদভাবে উঠে এসেছে। দুদকের প্রতিবেদনে তিতাসের দুর্নীতির প্রধান খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অবৈধ সংযোগকে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থাটির ছয় শতাংশ সিস্টেম লস হয় অবৈধ সংযোগের কারণে। বিভিন্ন কারখানা ও বাসাবাড়িতে চোরাই সংযোগ প্রদান ও লোড বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেন তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আবাসিকের চেয়ে শিল্পে গ্যাস চুরির হার বেশি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এতে বলা হয়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদন অনুসারে একটি অবৈধ সংযোগের জন্য তিতাসের কর্মচারীকে ৪৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।
দুদক জানায়, অর্থের বিনিময়ে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে বয়লার ও জেনারেটরে অনুমোদনের অতিরিক্ত লোডে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। মিটার বাইপাস করে গ্যাস সরবরাহ এবং ঘুষের বিনিময়ে মিটার টেম্পারিং করে গ্রাহকের প্রকৃত বিল গোপন করে দুর্নীতি করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যয় কম হওয়ায় হোটেল রেস্টুরেন্ট বেকারি, সুপারশপ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক গ্রাহকের পরিবর্তে শিল্প গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়া হয়। দুদক বলছে, শিল্পকারখানায় অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস দিয়ে তা বাসাবাড়িতে সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো হয়।
এদিকে গ্যাস সংকট মোকাবেলায় বর্তমানে দুটি বেসরকারি কোম্পানি দৈনিক ৫৩০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করছে। যদিও এ দুই কোম্পানি প্রতিদিন ১ হাজার ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু পাইপলাইনে সমস্যা থাকার কারণে পেট্রোবাংলা এই গ্যাস বিতরণ করতে পারছে না। দেশে বিদ্যমান দামের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি দামে এই এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। ফলে সরকারকে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। জ্বালানি বিভাগের হিসাব মতে, বর্তমানে যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি হচ্ছে তাতে বছরে ঘাটতি দাঁড়াবে ২৪ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণের টাকায় অতি উচ্চমূল্যে আমদানি করা গ্যাস কোনোভাবেই চোরদের কাছে বিকিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। এজন্য প্রথমেই তিতাসের দুর্নীতিবাজ কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার বন্ধে প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা ফলপ্রসূ হয় না। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, গ্যাস চুরি রোধে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে শিগগিরই মাঠে নামবে জ্বালানি বিভাগ। অধ্যাপক শামসুল আলমের মতে, কম চাপে গ্যাস দেওয়া ও সিস্টেম লস দেখানোর মাধ্যমে আবাসিক খাতে বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। শুধু গ্যাস চুরিই নয়, অবৈধ গ্রাহকের কাছ থেকে ভুয়া বিল আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে রাজধানী ও আশপাশের জেলাগুলোতে পাঁচ লাখ চুলায় অবৈধ সংযোগ নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিতাস দুই লাখ অবৈধ চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। সংশ্লিষ্ট থানায় এ-সংক্রান্ত দেড়শ' সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং একশ'র মতো মামলা করা হয়েছে।