সুজন কৈরী : রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার বারিধারায় যমুনা ব্যাংকের এটিএম বুথে ডিউটিরত সিকিউরিটি গার্ড মো. শামীম হত্যা মামলার আসামি পাঁচ মাস পর রহস্য উদঘাটনসহ হত্যাকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নাম- মো. কফিল। গত ১৫ মে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ির পূর্বধনিরাম গ্রাম থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় হত্যার কাজে ব্যবহৃত আলামত তার নিজ বাড়ি ভাটারার নয়ানগর মুন্সীবাড়ি তার মেস থেকে উদ্ধারের পর জব্দ করা হয়। ১৭ মে কফিলকে আদালতে সোপর্দ করা হলে শামীমকে হত্যায় নিজের দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়।
রোববার পিবিআই জানায়, নিহত শামীম ভাটারার বারিধারায় যমুনা ব্যাংকের এটিএম বুথে প্রতিদিনের মতো ২০ জানুয়ারি রাত ১০টা থেকে ২১ জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত ডিউটি করছিল। ২১ সকালে শামীমের বাবা বাদী নজরুল ইসলাম লোক মারফত জানতে পারেন, তার ছেলে শামীমকে অজ্ঞাতনামা কে বা কারা এটিএম বুথের ভিতরে মাথাসহ মুখ মন্ডলে শক্ত লোহার রড বা হাতুড়ি দিয়ে গুরুতর জখম করে হত্যার পর লাশ ফেলে গেছে। এ ঘটনায় ওইদিনই শামীমের বাবা নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে ভাটারা থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ ও পরে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করে। এরপর অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই মামলাটির দায়িত্ব পায়। পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের এসআই পুলক সরকার উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, গুপ্তচর নিয়োগ ও ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে কফিলকে হত্যাকারী হিসেবে সনাক্ত করেন। এরপর অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করেন। কফিল এলিট ফোর্স সিকিউরিটি কোম্পানীর গার্ড হিসেবে নিহত শামীমের সঙ্গে কর্মরত ছিল। হত্যার দিন শামীম বারিধারা জে-ব্লকের যমুনা ব্যাংকের এটিএম বুথে ও কফিল একই ব্লকে ইউসিবি ব্যাংকের এটিএম বুথে রাত্রীকালিন ডিউটি করছিলেন।
পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্টো (দক্ষিণ) এসপি মো. শাহাদাত হোসেন জানান, কফিল ও শামীম সম্পর্কে প্রতিবেশী ভাই। শামীম এলিট ফোর্সে চাকরি দেয়ার কথা বলে গত বছর কফিলকে ঢাকায় আনে এবং চাকরি দেয়। কফিল ঢাকায় আসার পর শামীমের বাসায় একমাস থাকে। কিন্তু একপর্যায়ে শামীমের বাবা-মা নিষেধ করলে কফিল বাসা ছেড়ে চলে যায়। এরপর পাশের এলাকায় থাকাকালে সাবিনা নামের এক মহিলার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার বেশ কিছুদিন পর কফিলকে সাবিনা তার বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে রাজী হলে একপর্যায়ে সাবিনার স্বামী কফিলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঘর-বাড়ী দেখেন ও কফিল সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। কিন্তু শামীম বিষয়টি জানতে পেরে কফিলের অর্থনৈতিক অবস্থা, বাড়িঘর ও স্বভাব চরিত্র ভাল না বলে জানালে সাবিনা এবং তার স্বামী বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। এজন্য কফিল শামীমের উপর ভীষনভাবে ক্ষুব্দ হয়। এছাড়া কফিল শামীমকে ধার হিসেবে দেয়া দুই হাজার টাকা টাকা শামীমের কাছে ফেরত চায়। কিন্তু শামীম টাকা পরিশোধ না করে ঘুরাতে থাকে। এসব কারণে ভীষনভাবে ক্ষুদ্ধ হয়ে ভিকটিম শামীমকে হত্যার পরিকল্পনা করে কফিল।
ঘটনার ২/৩ দিন আগে কফিল ভাটারার নতুন বাজার থেকে হাতুড়ি, সাদা প্যান্ট, সোয়েটার (জ্যাকেট) এবং মুখোশ কিনে একটি ব্যাগের ভিতরে লুকিয়ে রাখে। ঘটনার দিন ২০ জানুয়ারি ইউসিবি ব্যাংকের এটিএম বুথের ছাদ থেকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুয়ায়ী লুকিয়ে রাখা ব্যাগটি নিয়ে কিছুদূর সামনে গিয়ে পোষাক পরিবর্তন করে কফিল। এরপর ব্যাগটি পুনরায় আগের জায়গায় রেখে দেয়। পরে শামীমের যমুনা ব্যাংকের বুথে গিয়ে চাদর মুড়িয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় শামীমের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে পাঁচটি গুরুতর আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
এরপর কফিল যমুনা ব্যাংকের ভিতরের ক্যামেরা ভেঙ্গে বুথ থেকে বের হয়ে যায়। এরপর অন্য রাস্তা দিয়ে কফিল তার ডিউটিরত পোস্ট ইউসিবি বুথের ছাদ থেকে ব্যাগটি নিয়ে পোষাক পরিবর্তন করে এলিট ফোর্সর পোষাক পরে এবং খুনে ব্যবহৃত পোষাক, মুখোশ ও হাতুড়ি তার ব্যাগের ভিতর রাখে। এরপর ব্যাগটি নিয়ে বাসায় চলে যায় এবং তার মেসের রুমে ঢুকে ব্যাগটি রেখে দেয় কফিল। পরে শামীমের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে এবং লাশ ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামে নেয়াসহ দাফন ও যাবতীয় কাজে সহযোগিতা করে। হত্যাকান্ডের পর কফিল এলিট ফোর্সের চাকরি ছেড়ে দেয়। এমনকি বকেয়া বেতন ও বোনাসের টাকা নেয়ার জন্য আর ঢাকায় আসে নি।
আপনার মতামত লিখুন :