শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৯ মে, ২০১৯, ১০:১৭ দুপুর
আপডেট : ১৯ মে, ২০১৯, ১০:১৭ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ভূমধ্যসাগর যেন বাংলাদেশীদের জন্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল!

ডেস্ক রিপোর্ট  : মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে নানা পথ ঘুরে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশিরা লিবিয়ার ত্রিপোলি পৌঁছেন। সেখান থেকে ভূমধ্যসাগরের ভয়ঙ্কর পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হয় ইউরোপে। তাদের অনেকেরই তিউনেসিয়ার উপকূলে সলিল সমাধি হয়।

জীবন-মৃত্যুর এই সংকটকে মানব পাচারকারীচক্র ‘গেইম’ নামকরণ করেছে। কারণ কিছু নৌকা উত্তাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছে। অনেকগুলো ডুবে যায় যাত্রী নিয়ে। এমন দোলাচলে এমন যাত্রাকে ‘গেইম’ মানে খেলা হিসেবে দেখে পাচারকারী চক্র। ত্রিপোলিতে মানবপাচারকারী চক্রগুলো গেইম নামের টর্চার সেলও খুলে বসেছে।

সেই ‘গেইম’ ঘরে নির্যাতন চালিয়ে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে লুটে নেয় মোটা অঙ্কের অর্থ। অবৈধভাবে ইউরোপে পাচারকালে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশি নিহতের ঘটনায় র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া তিন মানবপাচারকারীকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে তদন্তকারীরা। একই সঙ্গে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান তারা। র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানবপাচারকারী বাংলাদেশি এসব চক্রের মূলহোতা হিসেবে কাজ করেন কথিত গুডলাক ভাই ওরফে নাসির উদ্দিন।

লিবিয়ার ত্রিপলিতে বসে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার চক্রের শতাধিক সদস্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানবপাচার করে আসছেন। আর এতে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। গুডলাক চক্রের অপর দুই ভাইও এর সদস্য। গুডলাকের মেঝ ভাই মঞ্জুর ইসলাম ও ছোটভাই রিপন। গুডলাক ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। এ চক্রের ঢাকায় থাকা সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করছে র‌্যাব।

অবশ্য চক্রের কয়েক সদস্যকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখার কথা জানায় একটি সংস্থা। এমন অন্তত ১৫টি চক্রের খপ্পরে পড়ে ইউরোপযাত্রার স্বপ্ন থমকে যায় সাগরের জলে ডুবে। অবৈধপথে ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে কখনো ঠাঁই মেলে জঙ্গলে তো কখনো প্রাণ যাচ্ছে তুষারপাতে। বাংলাদেশিদের এমন করুণ পরিণতির বিষয়টি দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হলে নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।

তবে চক্রের নিচের এবং মধ্যম পর্যায়ের কিছু সদস্য ধরা পড়লেও এখন পর্যন্ত মূলহোতারা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই চক্রের নামে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা ইতোমধ্যে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও শরিয়তপুরের নড়িয়া থানায় পৃথক দুটি মামলা করেছেন। এই মামলা দুটির সূত্র ধরে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে কাজ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

র‌্যাব জানায়, পৃথক আরেকটি চক্রের হোতা হলেন মিরাজ হাওলাদার। মাদারীপুরের কালকিনী উপজেলার বাসিন্দা মিরাজ লিবায়ায় বসে চক্রটির মাধ্যমে ইউরোপ পাঠানোর নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া সেখানে আটকে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ লুটে নিচ্ছে। এই চক্রের বিরুদ্ধে লিবায়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে অসংখ্য ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন।

দূতাবাস ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কেও এ বিষয়টি অবহিত করেছে। মানবপাচারকারী চক্রগুলো ইউরোপে পাঠাতে তিনটি রুট ব্যবহার করে। প্রথমটি হলো বাংলাদেশ থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে লিবিয়ায়। দ্বিতীয়ত, ভারত-ইস্তাম্বুল-লিবিয়া। তৃতীয় পথ হলো বাংলাদেশ হয়ে দুবাই-জর্ডান-লিবিয়া। ভিকটিমরা ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত গুডলাক ভাইসহ তার চক্রের সদস্যরা তাদের গ্রহণ করে। ত্রিপলি থেকে শুরু হয় ভয়ঙ্কর সাগরযাত্রা। আর তার আগেই সেখানে বসে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। অর্থ না দিলে তাদের ওপর চালানা হয় অমানুষিক নির্যাতন।

র‌্যাব জানায়, ভূমধ্যসাগরের তিউনেশিয়া উপকূল হয়ে ইতালি প্রবেশই থাকে তাদের মূল টার্গেট। এছাড়া ইউরোপের অন্য দেশও তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ইউরোপগামী কিছু জাহাজও অনেক সময় তাদের তুলে নিয়ে যায় বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে গ্রেপ্তারকৃতরা। অনেক সময় তিউনেশিয়ার পাশের মাল্টার কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়ে আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই মেলে। র‌্যাবের তদন্ত সূত্র জানায়, এই চক্রের অনেক সদস্যই বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তাদের গ্রেপ্তারে একাধিক টিম অভিযান পরিচালনা করছে।

শিগগিরই চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, ‘এই চক্রের নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। আমরা পুরো নেটওয়ার্ক ভেঙে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছি।’ এর আগে সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড যাওয়ার খবর বহু পুরনো। বর্তমানে এই যাত্রায় শামিল হয়েছে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এদিকে মানব পাচারের বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য চেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রাণালয়।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র তথ্য বলছে, লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার সময় প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এত মৃত্যু, ভয়, ক্ষুধাকে পেছনে ফেলে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ মে পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার মানুষ ইউরোপে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ অভিবাসী প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। এই মিছিলে বাংলাদেশিরাও রয়েছেন। সর্বশেষ ইউরোপ যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে নিখোঁজ হন ৩৯ বাংলাদেশি। তাদের একজন সিলেটের বিশ^নাথ উপজেলার রামপাশার নওধার গ্রামের তরুণ রেদওয়ানুল ইসলাম খোকন।

বাবার নাম ইলিয়াস আলী। পরিবারের সবার ছোট ছেলে তিনি। সিলেট সরকারি কলেজে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নওধার গ্রামের পার্শ্ববর্তী বৈরাগী বাজারে খোকনের বড় ভাই রেজাউল ইসলাম রাজুর ‘ফিজা এন্ড কোম্পানি’ নামে একটি ব্যবসা রয়েছে। যেখানে খোকন ও তার বাবা বেশিরভাগ সময়ই বসতেন। প্রায় ৬ মাস আগে বৈরাগী বাজারের পার্শ্ববর্তী কাঠলীপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম রফিক তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে খোকনকে ইতালি পাঠানোর প্রস্তাব দেন। মাত্র আট লাখ টাকায় ইতালি পাঠানোর কথা তার ফাঁদে পড়েন খোকন। কিন্তু সবার আদরের খোকনকে পাঠাতে চাননি তার পরিবার।

পরে তার জোরাজুরিতে রাজি হয় পরিবার। এখনো পরিবার জানে না কি ঘটেছে খোকনের ভাগ্যে। খোকনের মতো আরও অন্তত ৫ তরুণ ইউরোযাত্রার ওই নৌকার যাত্রী ছিলেন। পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম শাখার এআইজি মো. সোহেল রানা আমাদের সময়কে বলেন, ‘মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। এ ব্যাপারে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।’

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর, বিমানবন্দর, খিলগাঁও এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় জড়িত মানবপাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো এনামুল হক তালুকদার, মোহাম্মদ আক্কাস মাতুব্বর ও আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া। গ্রেপ্তারকৃত এই তিনজনকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। সূত্র- দৈনিক আমাদের সময়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়