বিভুরঞ্জন সরকার : সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে, এশিয়ার প্রায় ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য লজ্জার, হতাশার। আমাদের দেশে শিক্ষার মান নিচে নেমেছে এটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কিন্তু ঠিক কতোটা নিচে নেমেছে সেটা সম্ভবত আমরা কেউ জানি না। কারণ শিক্ষার মান নিয়ে কোনো বিশ্বাসযোগ্য জরিপ আমাদের এখানে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমরা অনেকদিন থেকেই বলে আসছি যে, আমাদের দেশে শিক্ষিতের হার বাড়ছে, হরেক কিসিমের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পরীক্ষা দিচ্ছে, পাসও করছে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠছে না। আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়ছে, হয়তো একটু বেশিই পড়ছে কিন্তু শিখছে কম।
শিক্ষার মান যে নেমে যাচ্ছে, সেটা আমরা কেউ বুঝতে পারছি না, তা-ও কিন্তু নয়। আমরা সমস্যাটা উপলব্ধি করছি, অথচ সমাধানের পথে হাঁটছি না। শিক্ষার মতো একটি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের এই ঔদাসীন্য-অবহেলা কেন? শিক্ষাকে জাতির মেরুদ- বলা হয়। আমরা মানহীন শিক্ষা নিয়ে কি মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারবো?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একসময় আমাদের গর্ব ও অহঙ্কারের শেষ ছিলো না। ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে খ্যাতি পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো মান গণনায় ঠাঁই না পেলে সেটা একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনে নেয়া যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু এ অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়াতে সহায়তা করেছে তা তো নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও মোড় পরিবর্তনকারী সব ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছে। মেধা-মননের চর্চার পাশাপাশি অধিকার সচেতন মানুষ তৈরিতেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাহলে এখন কেন এই দৈন্যদশা, কেন এ মলিন বেশ?
উত্তর আমাদের জানা নেই তা নয়। আমরা জানি গলদ কেথায়। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার ঝুঁকি কেউ নিতে চাই না। এই ঝুঁকিটা নিতে হবে। কাউকে না কাউকে সাহস করে বলতে হবে, ‘রাজা তোমার কাপড় কই’? না হলে এমন দিন আসবে যখন হয়তো আমাদের সবাইকে ন্যাংটা হয়ে তামাশা দেখাতে এবং দেখতে হবে। যারা র্যাংকিং করেছে, তাদের দোষারোপ করে লাভ নেই। তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। আমাদের ত্রুটি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং সমাধান করতে হবে। সমস্যা নিয়ে বসবাস করার কুঅভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ নিয়েও নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি ঢুকে যাওয়া কাদের জন্য লাভজনক আর কাদের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। আমরা রাজনীতিকে সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করে এবং এ নিয়ে অযথা আবেগতাড়িত হয়ে সর্বনাশ করেছি। মেধা ও সৃজনশীলতার সঙ্গে রাজনীতির বৈরিতা থাকার কথা নয়। কিন্তু ক্রমাগত মন্দ রাজনীতির চর্চা এটাকে বৈরি করে ফেলেছে। তাই আর আবেগ নয়, আমাদের বশ্যতা স্বীকার করতে হবে যুক্তির কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান ফিরিয়ে আনতে হলে সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাকে পরিহার করতে হবে। মেধা, কেবল মেধাকে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিতে পারলেই আমরা হারানো গৌরব ও মর্যাদা ফিরে পাবো। শরীরে রোগ যেমন আমরা পুষে রাখি না, তেমনি শিক্ষায় যে ব্যাধির বিস্তার ঘটেছে তা রোধেও আমাদের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রয়োজনে শল্য চিকিৎসাও।
লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়
আপনার মতামত লিখুন :