শিরোনাম
◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও

প্রকাশিত : ০৬ মে, ২০১৯, ০৬:৪৪ সকাল
আপডেট : ০৬ মে, ২০১৯, ০৬:৪৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

যে জীবনটা নিয়ে আমরা ফিরেছি ঢাকায় তাকে ‘নতুন কিংবা দ্বিতীয়’ জীবন বললে কম বলা হবে

মাসুদা ভাট্টি, ফেসবুক থেকে : বাংলাদেশ যখন ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় ফণী’র সঙ্গে যুঝছে তখন একটা জরুরী ও বিশেষ কাজে ফরিদপুর যেতে হয়েছিল আমাকে। ৪ঠা মে ফিরছিলাম সকালে। ফেরি বন্ধ বলে রাজবাড়ি-কুষ্টিয়া হয়ে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভুল ছিল কিনা জানি না। খুউব সুন্দর রাস্তা, প্রশস্ত এবং নতুন। চালক দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষিত এবং সাবধানী। যদিও প্রশস্ত ও ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সে একটু উচ্ছ্বসিত হয়েই চালাচ্ছিল। রাজবাড়ি মোড় থেকে মাত্র মাইলখানেক যাওয়ার পরই দ্যাখা গেলো সামনে একটি বাস ভয়ঙ্কর গতিতে যাচ্ছে,আমরা পেছন থেকে দেখছি, একটি বাঁকের দিকে যাচ্ছে বাসটি আর উল্টো দিক থেকে খুনে-গতিতে একটি ট্রাকও আসছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, ট্রাকটি গতি হারিয়েছে কারণ সে সোজা না এসে বাঁকা হয়ে আসছিল। আমি চালককে বলছি গতি কমাতে, বলতে বলতেই আমরা দেখতে পেলাম যে, ট্রাকটি বাসের পেটের মধ্যে ঢুকে গিয়ে বাসটিকে ঠেলে নিয়ে আসছে আমাদের দিকে, আমাদের গাড়ি এসে বাসের পেছনে ধাক্কা খেলো ভয়ঙ্কর জোরে, দু’টো শব্দ খুউব কাছাকাছি সময়ের, ট্রাকটি তখনও বাসটিকে প্রচণ্ড জোরে ঠেলছে, আর আমাদের চালকে সেটা দেখে বাসের পেছন থেকে বাঁয়ে কাটার চেষ্টা করায় আমরা নেমে গেলাম খাঁদের ভেতর, সেখানে একটি বিদ্যুৎসঞ্চালক খুঁটির সঙ্গে আবার ধাক্বা খেয়ে একটি ঢালুমতো জায়গায় গিয়ে গাড়ি ঝুলে রইলো। কতো মুহূর্ত বলতে পারবো না, গাড়ির ভেতর আমার খালাকে আমি এক হাত বাড়িয়ে টেনে ধরে রেখেছি, যদিও গাড়ির চালকসহ সকলেই আমরা সিটবেল্ট পরেছিলাম। চালক ছেলেটি আমার ছোট ভাইয়ের মতোই, ও আমার দিকে ফ্যাকাসে একটি চেহারা নিয়ে ঘুরে তাকালো, আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, বেঁচে আছি ভাই, ভয় নেই। এরপর দুই ঘন্টা ওই গাড়ির ভেতর বসা, বুঝতে পারছি না বেরুলে গাড়িটা পড়ে যাবে কিনা, ওদিকে ভয় যদি আগুন ধরে যায়?

৯৯৯-এ প্রথম ফোন করলাম, অল্পক্ষণেই একটি পুরুষকন্ঠ উত্তর দিলো, আমাকে অপেক্ষা করতে বলে হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে কনফারেন্স কল-এ সংযুক্ত করলো, হাইওয়ে পুলিশ খবর দিলো ফায়ার সার্ভিসকে, সবই চলছে আমাকে রেখে ফোনে। পুলিশ জানালো অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা আসছে। এরই মধ্যে অসংখ্য মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে, চিৎকার চেঁচামেচি চলছে। ট্রাক পালিয়েছে, কিন্তু রাস্তা ভরে তার বহন করে আনা বড় বড় সাইজের পাঙ্গাস মাছ ফেলে গেছে, মানুষ সেগুলো ধরার চেষ্টা করছে। আমরা গাড়ির ভেতর বসে সেসব দেখছি, গাড়ি ভর্তি কাঁচের গুড়ো, পায়ে পেয়েছি প্রচণ্ড ব্যথা নাড়াতে পারছি না, খালা অজ্ঞানমতো হয়ে গেছে, চালক সুমনকে আমি বেরুতে বলবো কিনা ভাবছি। ও চেষ্টা করছে কী ভাবে বেরুলে গাড়িটা আরও নীচে পড়া থেকে রক্ষা পায় সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য। দশ কি বারো মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস এসেছে, পুলিশ এসেছে, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না, কারণ রাস্তার ওপরে তখন বাসের ভেতর থেকে আঁটকে পড়া আহত-নিহতদের কেটে কেটে বের করা হচ্ছে। যেহেতু খাড়া ঢালে আঁটকে আছি সেহেতু কেউ কেউ সাহসি হয়ে এসে শুধু গাড়ির ভেতর লাশ দেখতে চায়। যতোই বলি কেউ মারা যায়নি কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। এর মধ্যে একজন পুলিশ এসে আমাদের খোঁজ নিয়ে গেছেন, বলেছেন আগে ঘটনাস্থলে নিহত ও গুরুতর আহতদের ব্যবস্থা করে তারপর আমাদের কাছে আসবেন।

রাজবাড়ি জেলার এসপি আসমা সিদ্দিকা মিলি, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তিনি আমাদের খুউব পরিচিত ডিআইজি মিলি বিশ্বাস, আমি সেই ভরসাতেই তাঁকে ফোন করি এবং আমাদের অবস্থার কথা জানাই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন যে, তিনি আসছেন। আমরা তখনও বসে আছি, এর মধ্যে যে সব ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বলার ক্ষমতা এই মুহূর্তে আমার নেই। আমার চালক ও খালা দু’জনকে ঠিক রাখতে গিয়ে আমি নিজেকে ঠিক রাখছি, আর ভাবছি, এতো কাছে এতোটাই কাছে যে মৃত্যু এলো, এতোগুলো মৃত্যু এতো কাছে ঘটে গেলো, একে আসলে কী বলবো? মীরাকল? অসম্ভব কোনো ঘটনা? জানি না। দু’ঘন্টা কিংবা তারও বেশি সময় আমরা গাড়ির ভেতর ওভাবে ঝুলে বসে আছি।

এসপি মিলি আপা এলেন। তার লোকজনকে দিয়ে আমাদেরকে গাড়ি থেকে বের করলেন। প্রথমে তার গাড়িতে বসালেন। তারপর নিয়ে গেলেন কাছেই সার্কিট হাউসে। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়িটা খাঁদ থেকে তোলার ব্যবস্থা হলো আরও ঘন্টা দু’য়েক পর। ততোক্ষণে সার্কিট হাউসে আমার সহকর্মী সাংবাদিকরা এসেছেন, পুলিশের এএসপি রাকিব এসেছেন, আমাদের অর্থনীতি পত্রিকার রিপোর্টার ইউসুফ এসে সব ব্যবস্থা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। নিহতের সংখ্যা নিয়ে তখন সাংবাদিক বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা চলছে, কেউ বলছেন ৬, কেউ ১২, পরের দিন জানা গেলো নিহত ১৫ জনও হতে পারেন। ঢাকায় ফিরে এসেছি, শরীরে কোনো রক্তচিহ্ন ছাড়া, ঘাঁড়-মাথা-পিঠের অসম্ভব ব্যথা পরে টের পেয়েছি। কিন্তু যে জীবনটা নিয়ে আমরা ফিরেছি ঢাকায় তাকে ‘নতুন কিংবা দ্বিতীয়’ জীবন বললে কম বলা হবে। আর কৃতজ্ঞতা কাকে জানাবো? সর্বময় ক্ষমতাকে তো বটেই, তারপর?

৯৯৯-সার্ভিসকে, হাইওয়ে পুলিশকে, ফায়ার সার্ভিসকে, রাজবাড়ি জেলার এসপি মিলি আপাকে, তাঁর সহকর্মীদেরকে, সার্কিট হাউসের সহকারী ভদ্রলোককে, সাংবাদিক বন্ধুদের, সহকর্মী ইউসুফকে, ফেরীতে যারা নিজেরা কষ্ট করে আমাদের ভাড়া করা গাড়িটাকে তুলে দিতে সাহায্য করেছেন তাদেরকে (তাদের কাছে ক্ষমাও চাইছি এখন, কারণ সেদিন না আসতে পারলে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে দেরি হলে হয়তো নতুন কোনো সমস্যায় পড়তাম), আর? অবশ্যই, সেই ভদ্রলোককে, যিনি একেবারে গাড়ির কাছে ঢাল বেয়ে নেমে এসে বলেছিলেন, “শুকুর করেন, বেঁচে আছেন, ধৈরযো হারায়েন না, পানি থাকলে খান, ওপরে যারা মারা গেছে তারাতো গেছে, আপনারা আছেন, আমি আছি ওপরে, ডাকবেন দরকার হলে”। ভদ্রলোকের কথায় ভরসা ছিল, খুউব ভরসা ছিল।

আমার সহকারী, ছোট ভাই এবং কাজে-অকাজে যার সহযোগিতা পাই চালক সুমনকে উপস্থিত বুদ্ধির জন্য কৃতজ্ঞতা, কৃতজ্ঞতা আমার খালা যার সঙ্গে একসঙ্গে বড় হয়েছি খেলতে খেলতে এখনও যিনি খালার চেয়ে বন্ধুই বেশি তার কাছে এরকম প্রায় মৃত্যুকালেও সঙ্গী হওয়ার জন্য, কৃতজ্ঞতা আমার বাসার সাহায্যকারী এবং প্রায় বন্ধু হয়ে যাওয়া মোমেনার কাছে, যে তার নিজের সংসার ফেলে এসে রাতভর তার ‘আপার’ পাশে এসে থাকে। আর সকল কৃতজ্ঞতা আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু-স্বজনদের কাছে, সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, নাসিমা খান মন্টি, মোজাম্মেল বাবু, মুন্নী সাহা, নবনীতা চৌধুরী, মিথিলা ফারজানা, ফারজানা রূপা, শবনম ফেরদৌসী, আমার প্রতিবেশি ডাক্তার দম্পতি বন্ধু তাদের ছেলেটা….আরও আরও নাম যাদের কাছে আমার ঋণ…মৃত্যুতেও এবং এই বেঁচে ফিরে আসা নতুন জীবনেও।

সবার কাছে শুভ কামনা চাই যেনো এই ভয়ঙ্কর ট্রমা, এই চোখ বন্ধ করলেই বিকট শব্দ আর গাড়ির ভেতর মৃত্যুর গন্ধ পাওয়া মনটাকে নিবিষ্ট করতে পারি। ভুলতে পারবো কিনা জানি না, কিন্তু একটা পর্দা এই দুঃসহ স্মৃতিতে আমায় টানতেই হবে, নাহলে সামনে আমার জীবনটা কেমন হবে কে জানে।

সেই যে গাড়িটি থেমে যাওয়ার পর পরই চালককে বলেছিলাম, বেঁচে আছি...এখনও এই একটি বাক্যই বলে যাচ্ছি ক্রমাগত নিজেকে.....

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়