আমিন মুনশি : শাপলা চত্বর নিয়ে রফিকের আগ্রহ আকাশচুম্বী। আর হ্যাঁ, রফিক হলো আমার শৈশবের বন্ধু। তার আপন বড়ভাই নাকি এখানে কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেছে। ২০১৩ সালের ৫ মে বাংলাদেশের সরকার বহু মুসলিমকে হত্যা করে এখান থেকেই মৃতদেহগুলো গুম করেছে। রফিকের বড় ভাইয়ের পরিচিত কে কে যেন সেদিন এখানে এসে আর ফেরেনি। এমন না ফেরা মানুষজনের কারো কারো লাশ আবার বিভিন্ন নদীতে ভেসে উঠতে দেখা গেছে...
২. মাদ্রাসার আবাসিক রুম থেকে এমনিতেই খুব একটা বাইরে বেরুতে মন চায় না আমার। সহপাঠী রেদোয়ান আর রফিকের পীড়াপীড়িতে আজ একটু ঘুরতে বেরুলাম। ৫ মে বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে আজ আমাদের ক্লাস নেই। ওপরের জামাতের ছেলেরা এখন তাদের রুমে অনুষ্ঠান করছে। ইসলামি বিপ্লবের রূপরেখা নিয়ে বড় হুজুর নিজেও সেখানে কিছু আলোচনা পেশ করবেন। আর ছোটরা পেছনের সারিতে বসে বড় ভাইদের বক্তৃতা আর জিহাদি তারানা শুনবে—প্রতিবছর এখানে এমনটাই হয়।
রেদোয়ান আর রফিক হলো আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু। সেই মক্তব থেকে আমরা একসাথেই লেখাপড়া করছি। বোর্ডিংয়ে যেদিন তরকারি ভালো হয় না সেদিন আমরা তিনজনে মিলে ভিন্ন আইটেমের আয়োজন করি। আমাদের তিনজনকে অনেকেই খুব হিংসা করে। ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতেও কম চেষ্টা করেনি অন্য সহপাঠীরা। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন আমাদের বন্ধুত্বটা এখনও টিকে আছে!
৩. সকাল থেকেই আজ রোদ একটু বেশি পড়ছে মনে হয়। মাদ্রাসার দারোয়ান চাচাকে ফাঁকি দিয়ে তিনবন্ধু যখন মতিঝিল চলে এলাম তখন বায়তুল মোকাররম মসজিদে জোহরের আজান শেষ হলো। আমাদের মধ্যে রফিক ছেলেটা খুব সাহসী। ওই বেশি জোর করেছে আমাদের এখানে আসতে। ও বলেছিলো, ‘এইদিনে নাকি শহীদের আত্মারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আসে। এখানে আসলে ওদের কান্না স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়। সরকার যে মুসলমানদের গণহত্যা করেছিলো তার প্রমাণ তো ওই আত্মাগুলোর গায়েবি কান্না।’
বাস থেকে নামার পর থেকেই শাপলা চত্বরে বেশ কয়েকবার চক্কর দিলাম। তিনজনের কেউই শহীদদের আত্মার কোনো কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম না। চারপাশে এতো এতো অফিস আর গাড়ির হর্ন যে আত্মাদের কান্না কোনভাবেই আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছলো না। মাঝে রফিক অবশ্য কয়েকবার সামান্য সামান্য শুনেছে বলে দাবি করেছে। কিন্তু আমি আর রেদোয়ান মোটেও সে রকম কোন সাউন্ড পাইনি। ‘এটা হইলো গিয়া বিশ্বাসের ব্যাপার। যারা বিশ্বাস করে কেবল তারাই এই গায়েবি শব্দ শুনতে পারে’—বললো রফিক। আমি রেদোয়ানের হাত ধরে বললাম, ‘আর ভালো লাগছে নারে। চল্ মাদ্রাসায় ফিরে যাই। বেশি দেরি হলে আবার দুপুরের খানা বন্ধ হয়ে যাবে। অন্য কোনোদিন হাতে আরও সময় নিয়ে আসবো। শাপলা চত্বরে শহীদদের গায়েবি কান্না সেদিন নিশ্চয় ভালোভাবে শুনতে পাবো।’
আপনার মতামত লিখুন :