রুহুল আমিন : বহুল বিক্রিত বইয়ের (উপন্যাস) লেখক কাসেম বিন আবুবাকারের। তার প্রথম উপন্যাস ‘ফুটন্ত গোলাপ’ ১৩৬ পৃষ্ঠার ফুটন্ত গোলাপেরই ৩২তম সংস্করণ শেষ। বাংলাবাজার কেন্দ্রীক প্রকাশনী সংস্থা ‘সাহিত্যমালা’ ১৯৮৬ সালে বইটি প্রথম প্রকাশ করে। ১০ বছর কপিরাইট মেয়াদ শেষে ১৯৯৬ সালে প্রাকশনার দায়িত্ব পায় নূর-কাসেম পাবলিশার্স। সায়ফুল্লাহ খাঁন জানান, ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি। বিক্রি করেছেন কয়েক লাখ কপি। আগের হিসাব তার জানা নেই। সাউথ এশিয়ান মনিটর
তবে শুধু ‘ফুটন্ত গোলাপ’ই নয় বাসর রাত, বালিকার অভিমান, বিদেশী মেম, বিদায় বেলায়, বিলম্বিত বাসর, অবশেষে মিলন, প্রেম যেন এক সোনার হরিণ, একটি ভ্রমর পাঁচটি ফুল, সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে, আমিও মানুষ, তুমিও মানুষ, শ্রেয়সী এবং ক্রন্দসী প্রিয়াসহ শতাধিক উপন্যাস লিখেছেন কাসেম বিন আবুবাকার। এর মধ্যে বিদেশী মেম উপন্যাসটির চলছে ১৭তম সংস্করণ, বর্তমানে ৮১ বছর বয়সী এই লেখকের ধারায় আরও লিখছেন অনেকে। যুক্ত হয়েছেন তার ছেলে সায়ফুল্লাহ খাঁনও। পুস্তক প্রকাশনার পাশাপাশি তিনি লিখছেন গল্প-উপন্যাস। বাজারে তার বই ১৫টি।
তাদের এ ধারায় আরও সহজ করে বর্তমানে যারা ‘উপন্যাস’ লিখছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মো. আকাশ চৌধুরী (বকুল), মো. আরিফুল ইসলাম (আরিয়ান), মো. আবু ইউসুফ (সৌরভ), মো. কহিনূর ইসলাম (শিশির), ফরহাদ হাসান সবুজ, মো. কামরুল হাসান, খোরশেদ আলম, মোস্তাক আহমেদ, শুভশ্রী নুপুর, সুমনা আক্তার সুমী, এমডি মুরাদ, এম এ কালাম। বাহারি নামে এবং বলিউড, ঢালিউড (ঢাকাইয়া চলচ্চিত্র) এবং টালিউডের (কলকাতার চলচ্চিত্র) বিখ্যাতসব নায়িকাদের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ সাজানো তাদের ওই লেখাগুলো ‘চটি উপন্যাস’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু অশ্লীল নয়। তবে বিষয় মূলে ‘কিশোর প্রেম’। এদের মধ্যে এম এ কালামের ২০০৪ সাল থেকে লেখা ২১টি উপন্যাসের মধ্যে তৃতীয় উপন্যাসটিরই নাম ‘প্রিয়া এখন অন্য কারো’।
বর্তমানে এ ধারার লেখকদের প্রতিনিধিত্ব করছেন এই এম এ কালামই। যিনি প্রকাশনী সংস্থা বিক্রয় প্রতিনিধি। পেশার পাশাপাশি এসব বই লিখছেন, আবার নিজের প্রকাশনী সংস্থা ‘কালাম বুক হাউজ’র ব্যানারে। অন্য লেখকদের বই প্রকাশও করছেন। ব্যানারে ঝুলছে এম এ কালামের ছবি সস্বলিত বিজ্ঞাপন বাজারে খুঁজে পাওয়া এই ধারার আরও কিছু ‘উপন্যাসের’ মধ্যে রয়েছে সুমনা আক্তার সুমীর ‘দু’ ফোটা চোখের জল’, শুভশ্রী নুপুরের ‘বড় বেশি ভালোবাসি তোমাকে’, ফরহাদ হোসেন সবুজের ‘ভালোবাসা হলো সংসার হলো না’, মো. কামরুল হাসানের ‘স্বার্থপর ভালোবাসা’, নুরুজ্জামান, শেখ সোহাগের ‘কণ্ঠের মাধুর্যে প্রেম করা ভুল’, মো. আকাশ চৌধুরী বকুলের ‘না বলা ভালোবাসা’, মো. আরিফুল ইসলাম আরিয়ানের ‘শুধু তোমার জন্য’ এ এম সোহাগের ‘এই মন তোমাকে দিলাম’ এবং মো. আবু ইউসুফ সৌরভের ‘ভালোবাসার শেষ নেই’।
তবে সম্প্রতি বাজার অনুসন্ধানে জানা গেছে, নামে এমন আকর্ষণীয় ও বাহারি হলেও বর্তমানে বিক্রিতে মন্দা এসব ‘চটি উপন্যাসের’। আগে যেখানে বাংলাবাজারের সোহেল বুক ডিপো, তানিয়া বুক ডিপো, হিমু প্রকাশনী, মনিহার বুক ডিপো, একতা প্রকাশনী, শরীফ বুক ডিপো এবং সাগর বুক ডিপোসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা এসব ‘চটি উপন্যাস’ প্রকাশ ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ছিলো। সম্প্রতি বাংলাবাজার খুঁজে শুধু সাগর বুক ডিপোতে উপরে উল্লেখিত লেখকদের বইকয়টি পাওয়া গেছে। সাগর বুক ডিপোর কর্ণধার সাগর হোসেন বলেন, এসব বই এখন আর চলে না। কেউ প্রকাশও করে না। সপ্তাহ খানেক হলো ১০ কপি করে কয়েকজন লেখকের বই উঠিয়েছি। প্রতি কপি বইয়ের দাম ১৫ টাকা। কিন্তু এক কপিও বিক্রি হয়নি।
২০১০ সালের দিক থেকে মন্দার এ ধারা শুরু হয়েছে বলেও জানান সাগর হোসেন। কারণ হিসেবে তিনি দায়ি করেন ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউবকে। যে মনের কথা বলে’। এই বইটিরও অনেক সাড়া পেয়েছিলাম। এর আগে ১৯৯৫ সালের দিকে হাফিজ লাইব্রেরী প্রকাশ করেছিলো এম ডি মুরাদের ‘হৃদয় দেবে কি দেবে না’। ওই সময়ে এই বইটিও অনেক সাড়া জাগানো বই ছিল।” মজার বিষয় হলো সেই এম ডি মুরাদ এখনও লিখছেন। সাগর বুক ডিপোতেই পাওয়া গেল তার উপন্যাস ‘প্রেম দেবে কি দেবেনা’। কিন্তু এবার আর সাড়া জাগছে না। জানা গেছে, ওই সময়ে পাঠক প্রিয় লেখকদের তালিকায় আরও ছিলেন- সোহেল রানা, আবু হানিফ, হুমায়ুন কবির মৃধা, চঞ্চল চৌধুরী, ও এইচ এম আলম হৃদয়। সোহেল রানার আলোচিত বই ‘অনেক স্বপ্ন ছিল তোমাকে নিয়ে’।
কালাম বলেন, লেখকের অভাব নেই। পুরনোদের জায়গায় নতুনরা এসেছেন। কিন্তু পাঠকেরই অভাব। মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুকেও ইউটিউব সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। মাত্র একটা ক্লিকেই সবাই পেয়ে যাচ্ছেন দুনিয়ার সব বিনোদন। আমাদের বই পড়ে বিনোদনের যুগ বুঝি শেষ হয়েই গেলো।
শহরের ফুটপাতে হকারদের বসায় কড়াকড়ির কথাও তুলে ধরেন এম এ কালাম। তিনি জানান, গ্রাম-গঞ্জে স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে আমাদের পাঠক ছিল। এছাড়া শহরাঞ্চলের বিশেষ করে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ যেখানে যেখানে গার্মেন্টস শিল্প কারখানা রয়েছে ওইসব এলাকার শ্রমিকদের আসা যাওয়ার রাস্তার ফুটপাতে বিক্রি হতো এসব বই। এখন ফুটপাতে বিক্রিও কমে গেছে। ফলে ‘প্রযুক্তি’ যার প্রভাবে পাঠক পেয়েছে ভিন্ন স্বাদের পথ, তাতে সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে এদেশের আদি একটি অধ্যায়ের। প্রশ্ন হচ্ছে, কালাম, মুরাদ, নুপুর ও সূমীরা কি খুঁজে নিতে পারবে নতুন কোন পথ?
আপনার মতামত লিখুন :