রাশিদ রিয়াজ : আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি সোমবার একটি ভিডিও প্রকাশ করে জানান দিলেন তিনি বহাল তবিয়তে জীবিত আছেন ও ওই জঙ্গি গোষ্ঠী পরিচালনা করছেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালে ইরাকের মসুলের বিখ্যাত আল-নুরি মসজিদে খুৎবা দিয়ে ইরাক ও সিরিয়ার কিছু অংশজুড়ে খেলাফত ঘোষণা করে ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন।
সোমবার আইএসের আল-ফুরকান মিডিয়ার প্রকাশিত ভিডিওটিতে জঙ্গি গোষ্ঠীটির আওতাধীন বিভিন্ন অঞ্চল হারানোর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি করেন আবু বকর আল-বাগদাদি। ১৮ মিনিট সময়ের এ ভিডিওটিতে আল-বাগদাদি সিরিয়ার বাঘুজে আইএসের পরাজয় স্বীকার করে নেন এবং ফের প্রতিশোধের হুমকি দেন। সিরিয়ার বাঘুজেই ছিল আইএসের সর্বশেষ ঘাঁটি।
সদ্য প্রকাশিত ভিডিওতে আল-বাগদাদি বলেন, বাঘুজের যুদ্ধ শেষ হলেও আরও অনেক কিছু বাকি আছে। ভিডিওটি ঠিক কবে ও কোথায় ধারণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে বিবিসি। যদিও আল-ফুরকান মিডিয়ার দাবি, এটি এপ্রিলে ধারণ করা। এদিকে ভিডিওর ব্যক্তি আদৌ আবু বকর আল-বাগদাদি কিনা, তাও নিশ্চিত করে বলতে পারেনি বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
এ বিষয়ে রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ভিডিওটি ঠিক কবে ধারণ করা হয়েছে এবং তা নির্ভরযোগ্য কিনা, তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ভিডিওর শুরুতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয়। আবু বকর আল-বাগদাদিকে বিশেষ ভঙ্গিতে মাটিতে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। এ সময় তার আশপাশে আইএসের কিছু কর্মীকে দেখা যায় মুখোশ পরিহিত অবস্থায়। এতে আল-বাগদাদি বাঘুজের পরাজয়ের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা হামলার বিষয়েও কথা বলেন। একই সঙ্গে মালি ও বুরকিনা ফাসোয় জঙ্গি গোষ্ঠীটির কর্মীদের তৎপরতার প্রশংসাও করেন তিনি।
এর আগে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এমন দাবিও করা হয় যে আইএস প্রধান আল-বাগদাদি হয়তো রাকায় রুশ বিমান হামলায় নিহত হয়েছে। রাকায় আইএস’র এক কথিত গোপন সভাস্থল লক্ষ্য করে রুশ বিমান হামলায় তিনশো ত্রিশ জন নিহত হয়। এর আগেও কয়েকবার তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিল। গণমাধ্যমে বেশ কয়েকবার এরকম খবর বেরিয়েছিল যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলায় বাগদাদি নিহত হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা তখন জানিয়েছিলেন, বাগদাদি নিহত হয়েছেন কিনা সেটা তারা নিশ্চিত করতে পারছেন না। ইরানের একজন কর্মকর্তাও জানান, যে তিনি নিশ্চিত আল-বাগদাদি নিহত হয়েছেন।
৪৭ বছর বয়স্ক আল-বাগদাদির এ ভিডিওটি বার্তাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ইন দি হসপিটালিটি অব দি আমির অব দিন বিলিভার্স’ নামে। এবং তার এ বার্তা ক্রুসেডারর্সদের সঙ্গে চলমান যুদ্ধ সম্পর্কে বলেও অভিহিত করা হয়। আল-বাগদাদি দাবি করেন ৮টি দেশে তার অনুসারীরা ৯২টি অভিযান পরিচালনা করেছে। আল-বাগদাদির পাশেই একটি মেশিনগন দেখা যায়। তার পরনে ছিল কালো পোশাক ও স্টোন জ্যাকেট। তার দাঁড়ির কিছু অংশ পেকে গেছে। যা এর আগে আল-নূর মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখার সময় দেখা যায়নি। গত বছর সিরিয়ার হোমে বাগদাদির কিশোর পুত্র হুদায়ফা আল-বাদরি মারা যায়।
জঙ্গি বিশেষজ্ঞ রিটা কাৎজ বলেছেন, আল-বাগদাদি জীবত থাকা এবং তার পুনরায় প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা দুশ্চিন্তার বিষয় এবং তার এধরনের ভিডিও বার্তায় তার অনুসারীরা পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উৎসাহ পাবে। এমনকি বুরকিনা ফাসো ও মালির জঙ্গি হামলার প্রশংসা করে আল-বাদদাদি বলেন তার অনুসারীরা যথার্থই করেছে। শ্রীলংকার চার্চ ও পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে আইএস জঙ্গি হামলার মত আগের চেয়ে ফের ভয়াবহ হামলা করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করে রিটা কাৎজ বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই আইএস অনুসারীরা ইন্টারনেটে কৌশলে বিভিন্ন ধরনের বার্তা প্রকাশ করছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আইএস বিরোধী জোট হুঁশিয়ার করে বলছে যখন ধারণা করা হচ্ছে আইএস জঙ্গি নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে গেছে তখন নতুন করে আল-বাগদাদির এই হুমকি ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া এমনকি ইরান ছাড়া এশিয়ার ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতের মত দেশগুলোকে সতর্ক হবার জরুরি বার্তা দিচ্ছে।
ইরাকে জন্ম নেওয়া এই আইএস নেতার আসল নাম ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আল-বাদরি। গত পাঁচ বছরে তার কোনো ভিডিও বার্তা প্রকাশিত না হলেও গত বছরের আগস্টে তার একটি অডিও বার্তা প্রকাশিত হয়েছিল। মূলত সিরিয়ায় আইএসের একের পর এক পরাজয় থেকে মানুষের দৃষ্টি ফেরাতেই ওই সময় অডিও বার্তা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
আবু বকর আল-বাগদাদির সন্ধান দিতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে। অথচ ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বাগদাদি ধরা পরলেও ইরাকে তিনি ছাড়া পান। এর আগে আফগানিস্তানের তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের মৃত্যুর খবরটি তালেবান ও আল-কায়েদা প্রায় দুই বছর পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছিল। ১৯৭১ সালে বাগদাদের উত্তরে সামারা এলাকায় আল বাগদাদির জন্ম। ২০০৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকে সামরিক অভিযান চলে, তখন আল বাগদাদি বাগদাদের একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন। অনেকের বিশ্বাস, সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলেই আল বাগদাদি জঙ্গি জিহাদিতে পরিণত হন। যখন তাকে দক্ষিণ ইরাকে একটি মার্কিন সামরিক ক্যাম্পে চার বছর আটকে রাখা হয়েছিল তখনই আসলে আল বাগদাদি জঙ্গীবাদে দীক্ষা নেন। ওই ক্যাম্পে অনেক আল কায়দা কমান্ডারকে বন্দী রাখা হয়েছিল। এরপর আল বাগদাদি ইরাকে আল কায়দার নেতা হিসেবেও আবির্ভূত হন। পরে অবশ্য ইরাকের আল কায়েদা নিজেদেরকে ২০১০ সালে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড লেভান্ট’ বলে ঘোষণা করে।
আপনার মতামত লিখুন :