প্রতীতি শিরিন : ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশে যখন বাংলা নতুন বছর ১৪২৬ উদযাপন শেষই হয়নি, তখন বিশ্ববাসী দেখলো, ফ্রান্সের বিখ্যাত স্থাপনা-নটরডেম ক্যাথেড্রালে ভয়াবহ আগুন। ধসে পড়েছে গির্জাটির প্রধান অংশের চূড়া। সংস্কার কাজ চলার সময় এটিতে আগুন ধরে যায়। ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম লা মিজারেবলে গির্জাটির পরিপূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠেছিলো। বিশ্বজুড়ে বসবাসরত প্যারিসবাসী এবং অন্যান্যরা যখন গির্জাটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছে বা ধর্মীয় সংগীত গাইছে, তখনই এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটলো। গুচির মতো বিখ্যাত ও বড় বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো গির্জাটি পুনর্নিমাণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দান করার কথা ঘোষণা করলো। আবার ব্যক্তিগতভাবেও অনেকেই সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। নটরডেমের মূল নকশা ঠিক রেখেই এটি পুনর্নিমাণ সম্ভব বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
নটরডেম ক্যাথেড্রাল মধ্যযুগীয় স্থাপনা। হতে পারে এটি ফরাসি জনগণের একতা ও সংস্কৃতির প্রতীক। কিন্তু এটি এক অভাবনীয় ব্যাপার যে, গির্জাটি পুনর্নিমাণের জন্য কিছু দাতা কোম্পানি বা ব্যক্তি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দান করতে দ্বিধা করলো না, তাও মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। অথচ অনেক বড় বড় বৈশ্বিক ইস্যু যেমন : দারিদ্র্য দূরীকরণ, এইচআইভি বা সবার জন্য টেকসই শিক্ষা নিশ্চিতকরণ বা এ ধরনের সমস্যাগুলো শুধু অর্থের অভাবে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলো এসব সংস্থার সমালোচনা করেনি। কিন্তু উন্নত বিশ্বের এ ধরনের সমস্যার প্রকৃতি তাদের অদ্ভুত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবকেই দেখিয়ে দিলো, যারা শুধু নিজেদের চিন্তায় বিভোর।
স্বীকার করুন আর নাই করুন, ক্ষুধা, এইচআইভি বা সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ পশ্চিমা বিশ্বের সমস্যা নয়। এটি তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা। পশ্চিমা বিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহায়তা বা দানের বিষয়টি শুধু এটি প্রকাশ করে যে, তারা যদি ভালো কাজের ইচ্ছা প্রকাশ করে তাহলে তারা অনেক কিছু করতে সক্ষম। এমনকি তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা সমাধানও সম্ভব। অর্থ সাহায্যের বিষয়টি তাই পশ্চিমাদের বিত্ত ও ক্ষমতাকেই শুধু প্রদর্শন করে। অর্থ সহায়তার বিষয়টি এটিই দেখায় যে, বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে তাদের অর্থের অভাব নেই, কিন্তু ইচ্ছা শক্তির অভাব রয়েছে। অর্থ সহায়তা এমন এক রাজনীতি যা বৈশ্বিক সমস্যা টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। এইচআইভি শুধু আফ্রিকারই সমস্যা নয়। দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাব বিশ্বের বিশেষ একটি অঞ্চলের সমস্যা। এ ধরনের সমস্যার সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী কে?
এইচআইভি ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিরিট্রোভ্যাল ঔষধ তৈরি ও বিতরণের বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা পরিচালনা করে পশ্চিমারাই। যুক্তরাষ্ট্র বন্দুক ও বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র প্রস্তুতকারক দেশ। এখন কথা হলোÑযদি দারিদ্র্য দূর করা হয় তাহলে তাদের অস্ত্রের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ দারিদ্র্যের একটি প্রধান কারণ হলোÑগৃহযুদ্ধ। তাহলে কেন পশ্চিমা বিশ্ব পৃথিবীর দক্ষিণ অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে, যখন এই দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়েই তারা আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছে? বিশেষ করে এই সমস্যাগুলো যখন তাদের নেই।
এভাবেই নির্ভরশীলতার রাজনীতি চলছে। যতোদিন তৃতীয় বিশ্ব বা বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চল শোষিত ও নিপীড়িত হবে, ততোদিন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব এই দেশগুলোর ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করে যাবে। এটাই সত্য। যদিও পশ্চিমারা তাদের ত্রাণকর্তা নয়। নটরডেম ক্যাথেড্রাল পুনর্নিমার্ণে বিলিয়ন ডলার দান সহায়তার বিষয়টি এই কথাটিই আবারো মনে করিয়ে দিলো।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
আপনার মতামত লিখুন :