মেজর খোশরোজ সামাদ : ১। ইস্টার সানডেতে শ্রীলংকায় গির্জা এবং হোটেলে সিরিজ বোমা হামলা করে নৃশংসভাবে প্রায় তিনশতাধিক পুণার্থীকে হত্যা করা হয়। শ্রীলংকা সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে দোষীদের পরিচয় এখনও প্রকাশ করেনি বা করতে পারেনি। প্রকারান্তরে আইএস তথা ইসলামিক স্টেট এই ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। আলোচনার খাতিরে তাদের দাবিকে সঠিক বিবেচনায় নিয়েই কথা বলতে প্রয়াস পাচ্ছি। যদিও ইতিহাস বলে অতীতে আইএস অন্যের কৃতকর্মের ক্রেডিট হাইজ্যাক করে নিজের নামে চালিয়েছে।
২। আইএস একটি উগ্র মৌলবাদী জঙ্গি ইসলামি গোষ্ঠী। সিরিয়া এবং এর আশেপাশে এদের নিবাস। সাদ্দাম হোসেনের ভেঙে যাওয়া সেনাবাহিনীর অনেক প্রশিক্ষিত পেশাদার সেনা আইএসে নাম লিখিয়েছে বলে ধরা হয়। খোদ ইউরোপের অনেক সুশিক্ষিত তরুণ, এমনকি বাংলাদেশের কিছু বিভ্রান্ত নারীও আইএস- এ যোগ দিয়েছে বলে জানা যায়।
৩। কেন এবং কীভাবে এই আই এসের উত্থান সে নিয়ে ব্যপক আলোচনার দাবি রাখে। তবে আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং সমাজতন্ত্রের আপাত পতন সারা পৃথিবীকে ‘আইডলজিক্যাল ক্রাইসিসে’ ফেলে দেয়। নতুন করে উত্থান শুরু হয় বিভিন্ন ধর্ম, গোত্র, জাতির উগ্রবাদী সংগঠন। নব্য নাৎসিবাদ, বর্ণবাদের মতো ঘৃণ্য মতবাদে উচ্চ শিক্ষিত কিছু লোক মাথা ন্যাড়া করে। ভারতে উত্থান হয় উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তির। তারা একপর্যায়ে এতোই ক্ষমতাধর হয় যে মহাত্মা গান্ধীর মতো সেক্যুলার নেতার দেশে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রই চলে যায় ধর্মভিত্তিক শক্তির হাতে। ‘প্রাণি হত্যা করা মহাপাপ’ বুলি কপচানো বৌদ্ধরা শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সান সুচির দেশে মুসলমান হত্যার তা-বলীলা চালায়। অর্ধ শতাব্দীর চেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে ফিলিস্থিনিদের ওপর চালানো নির্যাতন নানা ছুতায় ইজরাইল মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়িয়ে দেয়।
৪। আরব বসন্তের নামে ধূর্ত মার্কিনিরা কূটচালে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের ভেতরে সশস্ত্র লড়াই লাগিয়ে দেয়। কোথাও মার্কিনিরা সরাসরি সেনা পাঠায়। ইরাক, লিবিয়া,সিরিয়া, ইয়মেনকে প্রায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে পরিণত করা হয়। এই সময়ে বিভিন্ন মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠীর একটি হিসেবে আই এস ব্যাপক শক্তি অর্জন করে। তাদের নেটওয়ার্ক ইউরোপ আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পরে।
৫। প্রশ্ন আসে আইএস সম্প্রতি এই বোমা হামলায় কেন শ্রীলংকাকে বেছে নিলো? এক কথায় এর উত্তর দেয়া কঠিন। তবে জঙ্গি হামলা ঠেকানোর জন্য ইউরোপ আমেরিকা সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেয়ায় সেখানে আইএস নতুন করে আক্রমণ পরিচালনার মতো নতুন করে শক্তিধর হয়ে উঠতে পারেনি। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বিরোধ প্রায় প্রকাশ্যে থাকায় আক্রমণ চালানো সহজ ছিলো। দীর্ঘদিন তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই দেশটির অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির ব্যাপক অপচয় ঘটে। অনুমান করা হয় তাদের গোয়েন্দাদের প্রধান দৃষ্টি তামিলদের দিকে থাকায় অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর প্রকারান্তরে গৌণ হয়ে পড়ে। আইএস এই সব কিছুই হয়তো বিবেচনায় নিয়েছিলো। এমনকি আইএস তামিল টাইগারদেরকে তাদের অপঘাতমূলক কর্মকা-ে ব্যবহার করেছে কিনা এই প্রশ্নও এসে পরে।
৬। আগেই বলেছি, এখনও শ্রীলংকা বা দায়িত্বশীল কোনো রাষ্ট্র অপরাধীদের সঠিক পরিচয় উদঘাটন করতে পারেনি। সত্য প্রকাশিত হোক। হামলাকারী এবং তাদের গডফাদারেরা যে ধর্মের, যে জাতিরই হোক না কেন পরবর্তী প্রজন্মকে শান্তির পৃথিবী উপহার দিতে গেলে তাদেরকে খুঁজে বের করে সর্বোচ্চ শান্তি দেয়া সারা পৃথিবীর কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের এখন একমাত্র দাবি।
লেখক : উপ-অধিনায়ক, আর্মড ফোর্সেস ফুড অ্যান্ড ড্রাগস ল্যাবরেটরী
আপনার মতামত লিখুন :