সাদাত হোসাইন : আব্বাকে বলি, ‘আব্বা একলা একলা বাড়ি থাকবেন ক্যামনে? ঢাকায় চলেন, একসাথে থাকবো। আব্বা বলেন, ‘ঢাকায় কী গরু পালন যাইবো? জমি জিরাত করন যাইবো? এক হাত পায়ে বল পাই না ভালো, তারপরও সক্ষম আছি। কারণ বাড়ির সামনে ক্ষেতে মৌসুমি শাকসবজি করি, ঢেঁড়স, চিচিঙ্গা, বেগুন, টমেটো, কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে ধান অবধি নিজের হাতে করি। ঢাকায় এইগুলান করন যাইবো?’ আমি হাসি। আব্বা সারাদিন ঘরে বসে থাকতে পারবেন না, আমি জানি। তারপরও মন মানে না।
আব্বারও না। আম্মাকে নিয়ে একবার গেলাম কুয়াকাটা। দিনটা ভালোয় ভালোয় কাটলো। রাত বাড়তেই সমস্যা শুরু। হাঁস-মুরগির ছোট ছোট ছাও-পোনা রেখে এসেছেন বাড়িতে, পাশের ঘরের চাচি দেখাশোনা করবেন, কিন্তু কোনো কারণে যদি গুনতে ভুল হয়ে যায়! যদি কোনো একটা বাচ্চা রাতে বাইরে থেকে যায়। একবার এমন হয়েছিলো। সারারাত খোপের বাইরে থেকে ট্যাঁওট্যাঁও করছিলো মুরগির ছানা। সেই ট্যাঁওট্যাঁও আম্মা বোধহয় সারাজীবনেও ভুলতে পারবেন না।
ওই রাতেও পারেননি। তার ধারণা, একটা দুটা বাচ্চা ঘরের বাইরে রয়ে গেছে, সেই বাচ্চা ট্যাঁওট্যাঁও শব্দে কাঁদছে। আম্মা সেই কান্নার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। তিনি সারারাত ঘুমালেন না। ফজরের আজান শেষে নামাজ পড়েই পোটলাপুঁটলি গোছাতে বললেন, ‘তোরা থাক। আনন্দ ফূর্তি কর। আমারে বাড়ির গাড়িতে তুইলা দে, আমি যাই...’
এই সেদিন, দিন কুড়ি আগে, আমি তখন সিডনিতে, দেখতে গিয়েছি অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি উলংগং। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি নীলাভ জলরাশির দিকে, এই মূহুর্তে ফোন, বাড়ি থেকে। ছোট বোন ফোন করেছে, ভাইয়া, আব্বা অসুস্থ। কী হইছে!’ আমি আঁতকে উঠি। গরুতে গুঁতা দিয়া ফালাই দিছে। কোমরে খারাপ ধরনের ব্যথা পাইছে। উঠে দাঁড়াইতে পারেন না। বমিও হইছে। অজানা আশঙ্কায় আমার বুক কাঁপে। মুহূর্তেই চোখের সামনের দৃশ্য ঝাপসা হতে থাকে। আমি বলি, এখুনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা। না হলে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা কর। আমি মাঈন, হৃদয় ওদের সদরঘাট পাঠিয়ে রাখবো। জামানও চলে আসবে গাজীপুর থেকে। আম্মা অবশ্য আব্বাকে একা ছাড়তে চান না। বাড়িতে হাজারটা ঝামেলা, সবকিছু ফেলে তিনিও আসতে পারছেন না। তিনি তাই স্থানীয় ডাক্তারখানায় নিয়ে যান। এক্সরে করান।
রিপোর্ট খারাপ কিছু নয়। ফ্র্যাকচার নেই। ডাক্তার বলেন ওষুধেই সেরে যাবে। সারেও। আমিও অতোদূরে বসে খানিক নিশ্চিন্ত হই। আজ মেলবোর্ন, কাল ব্রিসবেন, পরশু সিডনি ছুটে বেড়াই। কিন্তু দেশে ফিরে বুঝি আব্বার ব্যথাটা আসলে পুরোপুরি সারেনি। বারেবারে ফিরে আসছে। আব্বাও সবার উপর বিরক্ত। গত প্রায় এক যুগ ধরে স্ট্রোকের কারণে তার ডানদিকের অনেকখানি পক্ষাঘাতগ্রস্ততায় আক্রান্ত। এটি তিনি এতোদিনেও মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। দিনরাত আক্ষেপ, অসহায়ত্ব। তারওপর এখন এই বয়সে এসে আবার যদি কিছু হয়!
ভয় আমি যেমন পাই, তিনিও। ঢাকায় আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। এখানে ভালো চিকিৎসা হবে। আম্মার উপর খানিক রাগও যেন, আগেই কেন আনা হলো না। ঢাকার জন্য তীব্র ছটফটানি। আনাও হলো। প্রথম দফায় ডাক্তার দেখানো হলো। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই মুখভার। কারো সঙ্গে কথা বলেন না। চোখ ছলছল। কী হয়েছে, জিজ্ঞেস করলে জবাব দেন না। খেতে বসে খান না পুরোপুরি। কী হয়েছে? না ঘুমিয়ে একা রুমে সারাক্ষণ কানের কাছে ফোন। আমি বকা দিতে গিয়েও থমকে যাই। বুঝতে পারি, ফোনের ওপারের মানুষটার জন্য তার মন কেমন করছে! ওই মানুষটাকে ছাড়া তিনি থাকতে পারেন না, একটা মুহূর্তও।
কাছে থাকলে সারাক্ষণ ঝগড়া হয়, এই সেদিনও আম্মা, এই বয়সে রাগ করে ‘বাপের বাড়ি’ চলে গেলেন। আব্বাকে ফোন দিয়ে বললাম, নিয়ে আসেন গিয়ে, তিনি একগুঁয়ে গলায় বললেন, জীবনেও যাবেন না। মরে গেলেও না। অথচ আমি জানি, দুর্বল ডান হাতে তখন সবল বাঁ হাত দিয়ে পাঞ্জাবি পরাচ্ছেন। ড্রয়ার খুঁজে চশমা বের করছেন। সন্ধ্যার আগেই আম্মাকে তার বাপের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি জানেন, তাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না। দিন শেষে এরা কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারেন না।
চোখের কোণে জল জমে, বুক ভার হয়ে থাকে, মন কেমন করে। কিন্তু এরা তা পরস্পরকে মুখ ফুটে কখনো বলতে পারেন না। কোনোদিনই না। হয়তো কখনোই আমাদের মতো আয়োজন করে তারা কেউ কাউকে কখনো বলেননি, ভালোবাসি! অথচ না বলা সেই ভালোবাসা কী তীব্র, কী সোচ্চার, কী প্রবল হয়ে রয়ে যায় অনন্তকাল... ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :