আবু হাসান শাহরিয়ার : ‘গল্পগুচ্ছ’র সঙ্গে আমার পরিচয়ের আগে কলতাপাড়ার একটি ঘটনার কথা বলে নিই। না বললেই নয়। সেদিন ছিলো ১৮ এপ্রিল। বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের ঠিক পরদিন। কম বয়সী মামাদের একজন ভিটেয় বাঁশ পুঁতে তার ঘরের সামনে মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা উড়ালে ঘটনার সূত্রপাত। ২৬ মার্চের পর ওই পতাকা ময়মনসিংহ শহরের প্রতিটি বাড়ির ছাদে উড়তে দেখেছি। আমরা ছোটরাও হাতে নিয়ে পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়িয়েছি। এ নিয়ে কোনও বচসা হয়নি। হওয়ার সুযোগও ছিলো না। কেননা ময়মনসিংহ তখনও মুক্তাঞ্চল এবং সারাশহর মুক্তিকামী বাঙালির দখলে। কিন্তু কলতাপাড়ায় পতাকা উড়াতেই দুই পক্ষের বিরোধ দেখা দিলো। কয়েকজন দা-কুড়াল নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানেও দাঁড়াল।
কাছে গিয়ে বুঝলাম... উভয়পক্ষই মুক্তিকামী, কিন্তু এক পক্ষ পতাকা উড়ানোর বিপক্ষে এই যুক্তি দেখাচ্ছিলো যে, শহর দখলের পর কসাই টিক্কার সেনারা যদি গ্রামেও নজরদারি শুরু করে, কলাতাপাড়ার লোকজন স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছিলো জানলে এ গ্রামের সব ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। আশপাশের গ্রামগুলোও রক্ষা পাবে না। শেষ পর্যন্ত ওরাই জয়যুক্ত হলো। জীবন ও মৃত্যুর তখন গলায় গলায় ভাব। এবার আরেকটি বিষয়ের কথা বলি। সেখানেও জীবন ও মৃত্যু পাশাপাশি। কলতাপাড়ার কারও বাড়িতেই তখন কোনও ‘আউট বই’ ছিলো না। ছোটদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ধর্মগ্রন্থ ছাড়া আর কোনও বইই চোখে পড়েনি প্রথম দু-তিনদিন।
যারা শহর থেকে পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তাড়াহুড়োয় তাদের কারও এদিকটার কথা মনে পড়েনি। তবে শহর থেকে আসা এক খালা তার সঙ্গের পোটলাপুঁটলির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ এনেছিলেন। সেটি অনেক পড়ুয়ার মনের খোরাক মিটিয়েছিলো। শহরে থাকতে বইটি আমি মায়ের আলমারিতেও দেখেছি। কিন্তু কোনোদিন পড়ার আগ্রহ জাগেনি। কলতাপাড়াতেও যে খুব বেশি টেনেছিলো তা নয়। অনেকের হাত ঘুরে বইটি যখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলো, নেড়েচেড়ে দেখার জন্য হাতে নিয়েছিলাম। সূচিপত্র ঘাঁটার সময় ‘কঙ্কাল’ শিরোনামটি পছন্দ হলে গল্পটি বের করে এক বৈঠকেই পড়ে শেষ করেছিলাম। ‘কঙ্কালে’র ধারাবাহিকতায় পরদিন ‘কাবুলিওয়ালা’ ও ‘আষাঢ়ে গল্প’ শিরোনামের গল্প দুটিও। দ্বিতীয় দিনই বইটি আমার হাতছাড়া হয়। ‘গল্পগুচ্ছ’ হাতে আসার অনেক আগেই আমি কঙ্কালভয় পেরিয়ে এসেছি।
ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের বিজ্ঞানাগারেও একটি কঙ্কাল ছিলো। কিন্তু ওই নামের কোনও গল্প জীবনে সেই প্রথম। পুরোটা গল্প খুব মন দিয়ে পড়েছিলাম। ভীতিকর পরিবেশ দিয়ে শুরু হয়ে করুণরসে শেষ হওয়া ‘কঙ্কাল’ পড়ে আমি অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলাম। জীবিত ও মৃত মানুষের কথোপকথনে রচিত গল্পটি অন্য রকম এক বোধের জগতে নিয়ে গিয়েছিলো আমাকে। যার কঙ্কাল, যতোবারই সেই নারীর অল্প বয়েসের অপরূপ চেহারা কল্পনা করছিলাম, ততোবারই ঢাকার কাঁঠালবাগানে থাকাকালীন মায়ের মুখ ভেসে উঠছিলো চোখে। কী লাবণ্যই না ছিলো তখন সেই মুখে! যদিও তা কঙ্কাল হয়নি, আমাদের ছয় ভাইবোনকে সামলাতে গিয়ে মায়ের সেই লাবণ্যে চর পড়েছে রাজশাহী থাকতেই।
বড় হয়ে যখন ‘কঙ্কাল’ আবার পড়েছি, গল্পটির ভেতরে অধিকতর প্রবেশ করলেও কল্পনার কোনও রকমফের হয়নি। আমার কলতাপাড়ার মুগ্ধতা রবীন্দ্রনাথের পায়ের ধুলোও নিয়েছিলো ‘কঙ্কাল’ পাঠের পর। সেই মুগ্ধতা আজও আমাকে ছেড়ে যায়নি। (শৈশবের সিঁড়িগুলো-১৮)। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :