শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু, মানতে হবে কিছু নির্দেশনা ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা

প্রকাশিত : ০১ এপ্রিল, ২০১৯, ০৩:৫০ রাত
আপডেট : ০১ এপ্রিল, ২০১৯, ০৩:৫০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রুখে দাঁড়ানোর ভেতর দিয়েই থামবে সড়কে হত্যাকাণ্ড, থামবে অনাচার, অন্যায় ও দুর্নীতি

আফরোজা সোমা ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকরের মৃত্যুতে আমার এক নিকট বন্ধুকে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছিলাম। ছেলের জন্য পড়ার খরচা জোগাতে নিজের মাথায় নারিকেল তেলটুকুও দেবার বিলাসিতাও করতেন না বকরের মা। ছুটি-ছাটায় বাড়ি গেলে এলাকার অবস্থাপন্নদের ক্ষেতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতো বকর। সেই বকর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বেঘোরে প্রাণ হারালো।

তার খাতায় লেগে রইলো রক্তের দাগ। সেই রক্তমাখা খাতার ছবি আর বকরের খরচ হয়ে যাওয়া জীবনের গাঁথা ছাপা হলো প্রথম আলোয়। সেই গাঁথা পড়ে আমার এক নিকট বন্ধু তিনদিন ধরে কেঁদেছেন। ভাতের থালা সামনে নিতেই বকরের কথা বলতে বলতে তার কান্না উৎলে উঠেছে হেঁচকি দিয়ে। আমারই চোখের সামনে এমন ঘটনা না হলে আর কারো কাছে শোনা কাহিনী হিসেবে হয়তো এই গল্প আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো।

এই সেদিন চকবাজারে আগুনের ঘটনা ঘটলো। ঘটনার দুইদিন পর। তখন মাঝ রাত। বারোটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে। ফেসবুকে এক বন্ধুর স্ট্যাটাস দেখে ফোন দিলাম। ফোন ধরে অন্তত প্রথম মিনিট দশেক তিনি একটা শব্দও মুখে উচ্চারণ করতে পারেননি। কেঁদেছেন। শুধু কেঁদেছেন। কান্না চাপাতে গিয়ে গুঙিয়েছেন। কিছু একটা কথা বলতে গিয়ে যখনই মুখ খুলছেন আরো জোরে বেড়েছে তার কান্নার দমক। অনেক কান্নার পর একটু বোধহয় হালকা লাগে মানুষের। কান্না কিছু থিতিয়ে এলে তিনি বললেন, ‘আর ভালো লাগে না। মানুষের এতো কষ্ট!

এতোগুলো প্রাণ কেমন নিমিষে চলে গেলো। আর নেয়া যায় না।’ আমার চেয়ে বয়সে বড় আমার সেই নারী বন্ধুটি তখনো রাতের খাবার খাননি। তার আগের রাত ঘুমাননি। রাতভর টিভির সামনে বসেছিলেন বিমূঢ়। মানুষ এভাবে কাঁদে। লিমনের জন্য আমার খুব কান্না লেগেছিলো। বিশ্বজিতের স্ট্রাইপ স্ট্রাইপ শার্টটা ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ হয়ে উঠার ছবিগুলো দেখে কান্না উৎলে উঠেছিলো আমার। হয়তো আপনাদেরও বুকে রোদন উঠেছিলো।

ক’বছর আগে বাসে, ট্রাকে সমানে ছোড়া হচ্ছিলো পেট্রলবোমা। রোজ সকাল হচ্ছিলো পোড়া মানুষের ছবি দিয়ে। পত্রিকার পাতাগুলো মেতেছিলো কে কার চেয়ে বেশি আবেদনময় করে পোড়া মুখের ছবি ছাপাবে সেই প্রতিযোগিতায়! সেই থেকে কাবাবে আমার অরুচি। প্লেটে কাবাব দিলে পত্রিকায় দেখা পোড়া মানুষের চিত্র ভেসে ওঠে। কন্যা ও স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে সেই কথার মধ্যেই গুলি খেয়ে প্রাণ হারানো একরামের আর্তি আর তার স্বজনদের আকুলতা শুনে টানা কয়েক রাত ঘুমাতে পারিনি। একটু তন্দ্রা এলেই দুঃস্বপ্ন দেখে আবারো জেগে উঠেছি। সেদিন বনানীর আগুনের ঘটনায় টিভিতে কিয়ৎক্ষণের জন্য শুনেছিলাম মানুষের মর্মভেদী আর্তনাদ!

সে কী হাহাকার! বাঁচার জন্য সে কী মরিয়া ফরিয়াদ! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার হাঁটু অসাড় হয়ে এসেছিলো। আমি টিভির কাছ থেকে দূরে সরে গেছি। কিন্তু সরে কী আসলে থাকা যায়? আমার বুকের উপর একটি বাস উঠে পড়তে কতোক্ষণই বা লাগবে! একটা বদ্ধ ভবনের ভেতর আমারই স্বজন বাঁচার জন্য আকুতি জানাতে জানাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে যে পড়বে না সেই নিশ্চয়তাইবা কে দেবে? আমারই কোনো নিকট বন্ধু যে চলতি পথে বাসে গণধর্ষণের শিকার হবে না সেই নিশ্চয়তা কে দেবে?

আমারই কোনো পরিচিত লেখক বন্ধু যে অভিজিতের মতো পথে মরে পড়ে থাকবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? এভাবে এই নিরুত্তর প্রশ্ন নিয়ে কতোদিন? আর কাহাতক বয়ে নেয়া যায় এই পলাতক জিন্দেগী! মানুষের কান্না দেখলে আজও অনেকেরই কান্না পায়। বনানীতে প্রাণপণে ফুটো পাইপ আঁকড়ে থাকা শিশুটির মতো মানুষ আজও আমাদের আছে। এমন মানুষরা আছে বলেই হয়তো এখনো এ পোড়ার দেশে কিছু আশা বাকি আছে। কিন্তু এই মানুষরা আছে বিচ্ছিন্ন হয়ে।

তাদের একের সঙ্গে আরেকের কোনো যোগ নেই। আর দুর্নীতিবাজরা ঐক্যবদ্ধ। রসুনের গোড়ার মতো তারা একাট্টা হয়ে থাকেন। অন্যায় করেও তারা পার পেয়ে যায়। কারণ তারা দলবেঁধে সারাদেশে হাসপাতালগুলোতে সেবা বন্ধ করে দিতে পারে। তারা দলবেঁধে সারাদেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে। তারা দলবেঁধে মানুষের উপরে অতর্কিতে বোমা মেরে সটকে যেতে পারে। এটাই উৎকৃষ্ট সময়। এখনি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়তে হবে। পাড়ায় পাড়ায় দুর্নীতিবিরোধী কমিটি হওয়া দরকার। মহল্লায় মহল্লায় অনাচার বিরোধী সংঘ হওয়া দরকার। ছোট দুর্নীতি থেকে বড় দুর্নীতি, কোনোটিকেই ছাড় দেয়া যাবে না। কেউ পাড়ায় মাস্তানি করতে এলে তাকে সবাই মিলে ধরে ফেলুন। ধরে পুলিশে সোপর্দ করুন। পুলিশ যদি অন্যায়ভাবে সেই মাস্তান বা ক্ষমতাবানকে ছেড়ে দেন সেটিও প্রকাশ করুন।

এই উদ্যোগে সাংবাদিকদের বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ‘ইম্পেক্ট জার্নালিজম’ বলে একটা জিনিস আছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে আদতেই সমাজে ভূমিকা রাখার উদ্যোগ নেয়া। আপনারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করুণ। রুই-কাতলাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেন। এই লড়াইয়ে আইনজীবীদের আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আপনারা জেলায় জেলায় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করুন। তাদের অন্যায়কারী, দুর্নীতিবাজ এবং অন্যের জমি-বাড়ি-সম্পত্তি কেড়ে নিতে উদ্যত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলায় লড়তে বলুন। কোনো প্রভাবশালী যদি বিচারকে প্রভাবিত করতে চায় ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে সেগুলো প্রকাশ করে দেন। জনগণের ঐক্য ছাড়া এই দেশের ‘সর্বাঙ্গের ব্যথা’ সারবে না।

আমাদের খাদ্যে ভেজাল। আমাদের ঔষধে ভেজাল। আমাদের পানিতে দূষণ। আমাদের বায়ুতে দূষণ। আমাদের রাজনীতি মানে ভোগ-দখল-তেলবাজি আর নিজের আখের গোছানোর মচ্ছব। এই মাৎস্যান্যায় থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই জনতার জাগরণ। নইলে চুড়িহাট্টার মতো ঘটনা, আবু বকরের মতো অকাতর প্রাণ বিয়োগের ঘটনা, রানা প্লাজার মতো কেয়ামতের ঘটনা ভবিষ্যতে আরো ঘটতেই থাকবে।

আর আমার বন্ধুদের মতো আপনি এবং আপনার বন্ধুরাও নীরবে, একা একা ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠবেন অস্ফুট কান্নায়। সময় এসেছে। নিজের মাতৃভূমির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিন। মনে রাখবেন আপনি তুচ্ছ নন। আপনাকে কেউ এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারবে না। এমনকি একক মানুষের অনেক ক্ষমতা। যে মানুষ রুখে দাঁড়ায় তার সামর্থ্য সীমাহীন।

আসুন আমারা সকল মিলে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। একমাত্র রুখে দাঁড়ানোর ভেতর দিয়েই থামবে সড়কে হত্যাকা-, থামবে অনাচার, অন্যায় ও দুর্নীতি। আর রুখে দাঁড়ানোর ভেতর দিয়েই অর্থবহ হবে আমাদের সকল কান্না। ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়