শিরোনাম
◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ চলচ্চিত্র ও টিভি খাতে ভারতের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলেই ব্যবস্থা: ইসি আলমগীর  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো

প্রকাশিত : ৩১ মার্চ, ২০১৯, ১২:০২ দুপুর
আপডেট : ৩১ মার্চ, ২০১৯, ১২:০২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

লাশকাটা ঘরের জীবন্ত বাসিন্দারা কেমন আছেন

ডেস্ক রিপোর্ট : 'শোনা গেল লাশকাটা ঘরে/ নিয়ে গেছে তারে;/ কাল রাতে- ফাল্কগ্দুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হল তার সাধ।' কবি জীবনানন্দ দাশ তার 'আট বছর আগের একদিন' কবিতায় আত্মহত্যার কারণ খুঁজেছেন এক ব্যক্তির। কিন্তু যারা সাহিত্যের বাইরে গিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের নিক্তিতে লাশকাটা ঘরে মৃত্যুর কারণ খোঁজেন; কেমন আছেন তারা? ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক এবং বিভিন্ন লাশকাটা ঘরের দায়িত্বরত মর্গ সহকারীদের (ডোম) সঙ্গে কথা বলে জানা গেল- ভালো নেই তারা।

বছরের পর বছর ধরে মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের শিক্ষকরা বেতন-ভাতা ছাড়া লাশকাটার মতো কঠিন কাজটি করে যাচ্ছেন। হত্যাকাণ্ড বা আত্মহত্যা- মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের মতো কঠোর কাজটি করতে গিয়ে লাশকাটা ঘরের উৎকট গন্ধ হজম করছেন তারা কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই।

লাশকাটা ঘর বা মর্গে ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসকদের সহকারীদের পরিচয় ডোম। একটা মানুষের লাশ হয়ে যাওয়ার গোপন রহস্য জানতে তারা মৃতদেহের পচা-গলা মাংস ঘেঁটে, শরীর চিরে চিকিৎসকদের সহায়তা করেন। মর্গে একটা স্থায়ী চাকরির আশায় তারা লাশ কাটেন। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়- তারা শুধু লাশকাটা ডোমই থাকেন; চাকরিটা আর স্থায়ী হয় না।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের দেওয়া একটি প্রতিবেদনে বিচার নিশ্চিত হয় অনেক খুনির। এ জন্য তারা কি অনেক টাকা বেতন পান? তাদের সম্মানটাও কি অন্য চিকিৎসকদের চেয়ে বেশি? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক-চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয়। একজন চিকিৎসক বলছিলেন, 'লাশ কাটাছেঁড়ার পর সেলাই করার সুতাও চিকিৎসকের পকেটের টাকা দিয়ে কিনতে হয়। ছুরি-বাটাল ধারালো করতে হয় নিজেদের টাকাতেই।' চিকিৎসকের এই উক্তিতেই অতিরিক্ত বেতন-ভাতা তো দূরের কথা, গোটা ফরেনসিক বিভাগের দুরবস্থার চিত্রই ফুটে ওঠে।

মর্গে নানা কাজে জড়িত কর্মী আর ফরেনসিক চিকিৎসকরা বলছিলেন, যে পেশায় ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা নেই, যেখানে বছরের পর বছর বেকার খাটতে হয়; কখনও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পকেটের টাকা যায়; সেখানে বিশুদ্ধভাবে কিছু আশা করাও তো ঠিক নয়। এর পরও তারা বিবেকের তাড়নাতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনটা ঠিকভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন 'দ্য মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ'-এর সভাপতি অধ্যাপক সেলিম রেজা বলছিলেন, পেশাগত জীবনে লাশ কাটাকাটিতে তারা বেকার খেটে যাচ্ছেন। সম্মান আর সম্মানী না থাকলেও আছে প্রভাবশালীদের হুমকি।

তিনি জানান, অনেক বছর ধরেই তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঁচ হাজার টাকা এবং ধর্ষণজনিত কেস পরীক্ষায় তিন হাজার টাকা সম্মানীর দাবি জানানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছেন তারা। তারপরও কিছু হয়নি।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হারুন অর রশীদ বছরখানেক আগে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে অবসরে গেছেন। কর্মজীবনে হাজারখানেক লাশ কাটাছেঁড়া করে মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। তিনি জানান, কখনও অতিরিক্ত পারিশ্রমিক বা এ জন্য আলাদা সম্মানী পাননি। জীবনভর মর্গে বেকার খেটে গেছেন। এর পরিবর্তন হওয়া দরকার বলে জানালেন তিনি।

ফরেনসিক চিকিৎসক আর মর্গ সহকারীদের সঙ্গে কথা বলে লাশকাটা ঘরের জীবন্ত বাসিন্দাদের মর্মবেদনাটা আঁচ করা গেলেও বিস্তারিত জানালেন দ্য মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর মহাসচিব সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব শুরু করে এখন ওই বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত। ফরেনসিক মেডিসিনের এই বিশেষজ্ঞ জানান, মেডিকেল কলেজে সাধারণত আড়াইটা পর্যন্ত ক্লাস, পরীক্ষা বা দৈনন্দিন কাজ চলে। এর পর বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকরা ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা সেবা দেন। কিন্তু ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকদের তার বিভাগেই ময়নাতদন্তের আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয় বিকেল ৫টা পর্যন্ত। কিন্তু এই অতিরিক্ত কাজের জন্য যেমন অতিরিক্ত সম্মানী পাওয়া যায় না; আলাদা সম্মানও নেই।

তিনি বলেন, একটা হত্যাকাণ্ডের বিচারের আগে ফরেনসিক চিকিৎসকরা মৃত্যুর কারণ বের করে বড় দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। কিন্তু এই সেক্টরটা একেবারেই অবহেলিত। পেশাগত ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকায় দেশে ফরেনসিক বিভাগে নতুন প্রজন্ম আসতেও চায় না। এতে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যেমন তৈরি হচ্ছে না, তেমনি জোড়াতালি দিয়েই মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হচ্ছে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, দেশে ৩১টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। ফরেনসিক বিভাগের জন্য সরকারিভাবে শিক্ষকের পদ মঞ্জুরি রয়েছে পাঁচজন করে। সে হিসেবে ১৫৫ জন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার। কিন্তু এর অর্ধেকও নেই। শিক্ষক না থাকায় নতুন ছাত্রও তৈরি হচ্ছে না। এর মধ্যে রাজশাহী, রংপুর, নোয়াখালী ও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে কোনো ফরেনসিক শিক্ষকই নেই। মেডিকেল কলেজের বাইরে জেলা হাসপাতালের মর্গগুলোতে সিভিল সার্জনদের তত্ত্বাবধানে ময়নাতদন্ত হলেও তাদের বেশিরভাগই ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নন। ওই চিকিৎসক প্রশ্ন রেখে বলেন, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের অভাবের চিত্রটা যখন এমন, তখন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনটা কতটা নির্ভুল আশা করা যায়?

ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অপর এক শিক্ষক জানান, শুধু মর্গে কাজ নয়; ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক হিসেবে বিভিন্ন মামলায় সাক্ষ্য দিতে দেশের বিভিন্ন আদালতেও যেতে হয়। আদালতে যাতায়াতের জন্য তাদের পকেট থেকেই টাকা খরচ করতে হয়।

দ্য মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর একাধিক নেতা বলেন, তাদের দাবিদাওয়ার চেয়ে বড় বিষয়টা হচ্ছে, ন্যায়বিচারের স্বার্থেই ফরেনসিক বিভাগটা উন্নত ও আধুনিকায়ন করা উচিত। এ জন্য তারা বিভিন্ন ফোরামে কথাও বলেন। ফরেনসিক চিকিৎসকদের অতিরিক্ত কাজের জন্য অন্তত সম্মানী ভাতা চালু, আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাওয়ার সময় নিরাপত্তা এবং যাতায়াত খরচটা যাতে পাওয়া যায়, সে দাবি দীর্ঘদিন ধরেই তারা করে আসছেন।

এ তো গেল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কথা। কিন্তু কেমন আছেন মর্গ সহকারী বা ডোমেরা? তা জানতে বেশ কয়েকজন মর্গ সহকারীর সঙ্গে কথা হলো। তবে তারা নাম প্রকাশ করে কিছুই জানাতে চান না।

সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের মর্গ সহকারী মো. সেকান্দার ৩৫ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। কয়েক বছর আগে তার চাকরিটা স্থায়ী হয়েছে। তার ছোট ভাই রামু ১২ বছর বেকার খেটে হয়েছেন মর্গ সহকারী। ওই মর্গে আরও চারজন বছরের পর বছর ধরে লাশ কাটাছেঁড়া আর সেলাই কাজে সহযোগিতা করলেও তাদের চাকরিটা এখনও পোক্ত হয়নি।

সেকেন্দার শুধু জানালেন, মর্গই তাদের দিন-রাত। রাত ২টাতেও যদি মর্গে লাশ আসে তা তাদের বুঝে রাখতে হয়। ঝড়-বৃষ্টিতেও তাদের দায়িত্ব পালন বন্ধ হয় না।

সেকেন্দার এতটুকু বললেও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ওই বিভাগের মর্গ সহকারী শ্যামল চন্দ্রগুপ্ত কিছুই বলতে চাইলেন না। তিনি মর্গের খোঁজ নিতে সংশ্নিষ্ট বিভাগে কথা বলার পরামর্শ দিলেন।

শেষ পর্যন্ত খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শ্যামল প্রায় ১৫ বছর ধরে মর্গে ময়নাতদন্তে চিকিৎসকদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু ওই মর্গে তার চাকরি স্থায়ী হয়নি এখনও। দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে লাশ কাটাছেঁড়ার কাজ করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গেও একজন ডোমের চাকরি স্থায়ী। আরও চারজন সেখানে দায়িত্ব পালন করলেও তারা চলেন লাশের স্বজনের পয়সায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মফস্বলের মর্গ বা লাশকাটা ঘরে কাজ করা ডোমদের অবস্থা আরও খারাপ। কোনো কোনো জেলা মর্গে নির্দিষ্ট ডোমই নেই। মর্গে লাশ গেলে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের খবর দিয়ে এনে তাদের দিয়ে লাশ কাটানো হয়।
সূত্র : সমকাল

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়