শিরোনাম
◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী 

প্রকাশিত : ৩০ মার্চ, ২০১৯, ০৭:৫৪ সকাল
আপডেট : ৩০ মার্চ, ২০১৯, ০৭:৫৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মর্গ থেকে টাকা ছাড়া লাশ মিলে না

ডেস্ক রিপোর্ট :  সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মর্গে বিনা টাকায় ময়নাতদন্ত হওয়ার কথা। পাশাপাশি পুলিশ রেজ্যুলেশন অব বেঙ্গল বা পিআরবির প্রবিধি অনুযায়ী মর্গ থেকে লাশ হস্তান্তরের সময়েই পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি তুলে দিতে হবে। সে অনুযায়ী মর্গেই লেখার কথা প্রতিবেদনটি। অবশ্য বাস্তবতার নিরিখে সরকারি নির্দেশনায় সে সময়টা বৃদ্ধি করে ২৪ ঘণ্টা করা হয়েছে। সমকাল

কিন্তু বিভিন্ন মর্গে অনুসন্ধান করে জানা গেল, টাকা ছাড়া মর্গ থেকে লাশ বের হয় না। ময়নাতদন্তে নানা খাত দেখিয়ে নিহতের স্বজনের কাছ থেকে দুই হাজার থেকে শুরু করে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এজন্য কোনো রশিদ বা বৈধ কাগজও দেওয়া হয় না। অনুসন্ধানে এও দেখা গেল, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিধিটা পিআরবি আর সরকারি নির্দেশনাতেই আটকে আছে। কোনো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনই নির্ধারিত সময়ে দেওয়া হয় না। ঘণ্টা পার হয়ে দিন, মাস আর বছর চলে গেলেও বেশিরভাগ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায় না। মাসের পর মাস মর্গে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে  থাকার আড়ালেও বিভিন্ন মর্গ অফিসে টাকার খেলার তথ্য পাওয়া গেছে। ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভিন্ন কর্মী সংশ্নিষ্ট মামলায় পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এই টাকা নেন। নিহতের পরিবার এই টাকার উৎস হলেও অজ্ঞাতপরিচয়ে লাশের স্বজন না থাকায় আটকে থাকে সেসব  ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। কোনো কোনো ঘটনায় মামলার চার্জশিট জমা নিয়ে সময়ের বাধ্যবাধকতা থাকায় পুলিশের সংশ্নিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার পকেটের টাকা খরচ করেই নিতে হয় এই প্রতিবেদন। অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন থানার পুলিশ

কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত আলোচিত হত্যাকাণ্ড বা হত্যাকাণ্ড বোঝা যায়- এমন ঘটনাগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দ্রুতই পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মহত্যা বা অজ্ঞাতপরিচয়ে উদ্ধার লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মাস থেকে বছর পার হলেও তা আর তৈরি হয় না।

সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির বিলম্বের কারণে বদলে ফেলা হতে পারে মৃত্যুর আসল কারণ। ময়নাতদন্ত থেকে প্রতিবেদন দেওয়ার দীর্ঘ সময়ের ফাঁকে প্রভাবিত হতে পারেন চিকিৎসক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও। বিভিন্ন সময়েই ভুক্তভোগীরা টাকার বিনিময়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বদলে দেওয়ার অভিযোগ তুলে আসছেন।

পুলিশের সাবেক আইজি মো. নূরুল আনোয়ার বলেন, পিআরবি বিধি অনুযায়ী ময়নাতদন্ত শেষে লাশের সঙ্গে পুলিশ সদস্য বা কনস্টেবলের কাছে হস্তান্তর করা কার্বন কপিটিই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। কিন্তু বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলে তাতে বিলম্ব করা হয়। এই বিলম্বের মধ্যেই ঘটতে পারে অঘটন। বিধি অনুযায়ী পোস্টমর্টেম রিপোর্ট একটিই। বিস্তারিত রিপোর্ট বলে আইনে বা বিধিতে কিছু নেই।

পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, ময়নাতদন্তত-সংক্রান্ত সিআরপিসি ও পিআরবির ধারাগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করলে পরবর্তী সময়ে কোনো চাপ, ভয়ভীতি বা লোভের কাছে নতিস্বীকারের সুযোগ থাকে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার পথও নিশ্চিত হয়।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, তারা গবেষণা করে ময়নাতদন্তের ভুলের নানা কারণ দেখিয়েছেন। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের জন্য যথাযথ আর্থিক বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলেন। এই অর্থ বার্ষিক পুলিশ বাজেটে যুক্ত করার কথাও বলেছিলেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মর্গ পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরে লাশ আটকে টাকা নেওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেল। ভোলার লালমোহন এলাকার গৃহবধূ হাজেরা বেগমকে (২০) দগ্ধ অবস্থায় গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। ৯ মার্চ সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হাজেরার লাশ গ্রামে নিতে হাসপাতালে বিভিন্ন রোগীর স্বজন মিলে তার বৃদ্ধ মা সালেহা বেগমের হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন। কিন্তু চিকিৎসক তার মৃত্যুর খাতায় 'এসিড বার্ন' উল্লেখ করায় মরদেহ পরের দিন মর্গে পাঠায় পুলিশ। ময়নাতদন্ত করতে পুরো পাঁচ হাজার টাকাই মর্গে দিতে হয়েছে এই মায়ের।

হাজেরার একজন স্বজন মুক্তা আক্তারও ছিলেন মর্গে। তিনি বলছিলেন, লাশের গোসল, কাপড় আর বাক্স কেনার কথা বলে মর্গের লোকজন এই টাকা নিয়েছে। আরও বেশি চাইলেও দর কষাকষি করে তা কমানো হয়েছে। তবে কোনো রশিদ তারা পাননি।

যেসব খাত দেখিয়ে টাকা নেওয়া হয়েছে-বাজার যাচাই করে দেখা গেছে, বাক্স আর কাপড় কিনতে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকার বেশি লাগার কথা নয়। তাছাড়া মর্গে এই খাতে লাশের স্বজনের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়ার নিয়ম নেই। এমনকি লাশের ময়নাতদন্তে মর্গে এক টাকাও খরচ হওয়ার কথা নয়।

ঢাকার তিনটি মেডিকেল কলেজ মর্গে গত কয়েকদিন অনুসন্ধান করে এবং কয়েকটি জেলার মর্গে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের প্রায় সব লাশকাটা ঘরের চিত্রই অভিন্ন। মর্গে চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে বাইরে থেকে এসে যারা কাজ করেন, লাশের স্বজনের আবেগকে জিম্মি করে বিভিন্ন খাতের নামে তারা এই টাকা হাতিয়ে নেন। এজন্য মেডিকেল কলেজ মর্গগুলোতে রীতিমতো সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে।

২০১৭ সালের ২৩ মে রেললাইন থেকে লাশ উদ্ধার হয় অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। ওই ঘটনায় রেলওয়ে থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। মামলাটির তদন্ত করছেন ঢাকা রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, তার তদন্ত কাজ শেষ। কিন্তু প্রায় দুই বছর হতে চললেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনটি পাননি। কেন পাননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বুঝেন তো ভাই সবই। কিন্তু লাশের তো আর স্বজন নেই। আমি কেমনে কী করব?'

বিভিন্ন থানার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশের পুলিশ ছাড়া আর কোনো স্বজন থাকে না। এজন্য প্রতিবেদন পেতে কারও তদবিরও থাকে না। কাউকে 'খুশি' করাতেও কেউ যায় না। এতে ময়নাতদন্ত হওয়ার পর বছর পার হলেও প্রতিবেদনটা আর তৈরি হয় না। মামলার তদন্তও এগোয় না।

টাকা নিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন উল্টে দেওয়া বা টাকা ছাড়া প্রতিবেদন না পাওয়ার অভিযোগ সরাসরি অস্বীকারও করেননি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন দ্য মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক সেলিম রেজা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন ও টকসিকোলজি বিভাগের এই অধ্যাপক বলছিলেন, সব মানুষ তো লোভের ঊর্ধ্বে নয়। সেই লোভে পড়ার প্রস্তাবটা কারা দেয়, তা খুঁজে বের করা উচিত। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানে ময়নাতদন্ত আটকে বা তথ্য ঘুরিয়ে দিয়ে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই।

দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, হয়তো মেডিকেল কলেজগুলোতে এই সুযোগটা একেবারেই কম। কিন্তু মফস্বলের মর্গে নানা কারণে এমনটা হতে পারে। সেখানে প্রভাবিত হওয়ার যেমন পরিবেশ থাকে, তেমনি রক্তচক্ষুও উপেক্ষা করা যায় না। তাছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চিকিৎসক আর পুলিশের মধ্যকার কাজ হলেও বাদী বা বিবাদী পক্ষও এসে প্রভাব দেখায়, লোভে ফেলার চেষ্টা করে। অনেক সময়ে খোদ তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার প্রভাবও থাকে।

পুলিশ কর্মকর্তার প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, টাকা দিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ঘুরিয়ে দেওয়া বা টাকার জন্য ময়নাতদন্ত আটকে রাখার অভিযোগটা তাদের সব সময়েই শুনতে হয়। কারণ একটা হত্যাকাণ্ডে বাদী এবং আসামি দুটি পক্ষ থাকে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন কিন্তু একজনের পক্ষে যায়। সে ক্ষেত্রে অপর পক্ষ নানা অভিযোগ করতেই পারে। এর পরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

৭২ ঘণ্টার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বছরের পর বছর ধরে মর্গে আটকে থাকার বিষয়ে দুই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞই অভিন্ন মত দিলেন। তারা জানান, মূলত জনবলের অভাবে এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ কম থাকায় প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হয়। এ ছাড়া ভিসেরা প্রতিবেদনের জন্যও আটকে থাকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর প্রতিবেদন আগে দেওয়া হয়।

ঢাকার দুটি মর্গের দু'জন মর্গসহকারী (ডোম) নাম প্রকাশ না করে নিহত ব্যক্তির স্বজনের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তারা দাবি করেছেন, একটি লাশ কেটে সেলাই করে প্যাকেটসহ বাক্সবন্দি করে দেন তারা। এজন্য স্বজনরা 'খুশি' হয়ে যে টাকা দেন, তাই তারা নেন। কেউ না দিলে চেয়ে নেন না, জোরাজুরিও করেন না।

আটকে আছে শত শত ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন :পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সাধারণত অপমৃত্যুর মামলাগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। এজন্য মামলার পুলিশি তদন্ত শেষ হলেও অভিযোগপত্র দেওয়া যায় না। এর ফলে বিচার কাজে দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলার নিষ্পত্তিতেও সময় লাগে।

গত জানুয়ারি মাসের পরিসংখ্যান তুলে ধরে পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, সারাদেশে এক মাসের বেশি সময় ধরে এক হাজার ১১৮টি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে আছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় ৩৭৪টি, চট্টগ্রাম মহানগর থানাগুলোর ৭৫টি, ঢাকা রেঞ্জের বিভিন্ন থানার ১৯৪টি এবং খুলনা রেঞ্জের বিভিন্ন থানার ১৪৪টি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে আছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়