শিরোনাম
◈ টাইমের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় বাংলাদেশের মেরিনা ◈ দেশের মানুষকে ডাল-ভাত খাওয়াতে  ব্যর্থ হয়েছিল বিএনপি : প্রধানমন্ত্রী ◈ দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েল ফসফসরাস বোমা হামলা ◈ ঝালকাঠিতে ট্রাকচাপায় নিহতদের ৬ জন একই পরিবারের ◈ গাজীপুরের টঙ্গি বাজারে আলুর গুদামে আগুন ◈ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনোয়ারুল হক মারা গেছেন ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শনিবার ঢাকা আসছেন ◈ দুই এক পশলা বৃষ্টি হলেও তাপদাহ আরো তীব্র হতে পারে  ◈ এথেন্স সম্মেলন: দায়িত্বশীল ও টেকসই সমুদ্র ব্যবস্থাপনায় সম্মিলিত প্রয়াসের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ◈ কেএনএফ চাইলে আবারও আলোচনায় বসার সুযোগ দেওয়া হবে: র‌্যাবের ডিজি

প্রকাশিত : ২৯ মার্চ, ২০১৯, ০২:৪১ রাত
আপডেট : ২৯ মার্চ, ২০১৯, ০২:৪১ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আমাদের সত্যিকারের হিরো মিনার মাহমুদ

প্রভাষ আমিন : মিনার মাহমুদ মারা গেছেন সাত বছর আগে। কিন্তু সত্যি বলছি আমার বিশ্বাসই হয় না। মনে হয় মাঝে যেমন আঠারো বছর হারিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনই কোথাও গেছেন। আবার হয়তো ফিরে এসে ফোন করবেন, হেই ম্যান খবর কী? অথচ বাস্তবতা হলো এবার আর নির্ঘুম স্বপ্নের দেশে নয়, মিনার ভাই হারিয়ে গেছেন স্বপ্নহীন চিরঘুমের দেশে।

এখনকার প্রজন্ম মিনার মাহমুদকে চেনে না, অনেক কষ্ট করে চেনাতে হয়। কেউ কেউ চেনে তসলিমা নাসরিনের স্বামী হিসেবে। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ‘বিচিন্তা’ প্রকাশ করে মিনার ভাই সাংবাদিকতায় বিপ্লব করেছিলেন ১৯৮৭ সালে, মাত্র আটাশ বছর বয়সে। আর এখন যারা সাংবাদিকতার তরুণ প্রজন্ম তাদের অনেকের জন্ম তারও অনেক পরে। তাই মিনার ভাইকে নিয়ে আমাদের লেখালেখি তাদের কাছে আদিখ্যেতা মনে হয়। মিনার মাহমুদ কেন প্রয়োজনীয়? আমি মনে করি, বিশ্বাস করি, এখন যে আধুনিক-স্মার্ট সাংবাদিকতার চল, তার আদি পুরুষ মিনার মাহমুদ। তাই তাকে আমাদের স্মরণ করতেই হবে।

আমার বাস্তবে দেখা সত্যিকারের হিরো মিনার মাহমুদ। শুধু আমার নয়, মিনার মাহমুদ আমাদের সময়ের হিরো, সত্যিকারের হিরো। তিরিশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে অনেক ‘হিরো’র দেখা পেয়েছি। কিন্তু অনেকের কাছে যাওয়ার পর উবে গেছে সব আবেগ। একমাত্র মিনার মাহমুদ আমাদের হিরো ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

মিনার মাহমুদ নাটকীয়তা ভালোবাসতেন। তার গোটা জীবনটাই নাটকীয়তায় ভরপুর, এমনকি মৃত্যুটাও। পরিকল্পনা করে, গুছিয়ে, অভিজাত হোটেল রিজেন্সিতে রুম ভাড়া করে, প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য চিঠি লিখে চলে যাওয়াটা নাটকীয়ই। মিনার মাহমুদ প্রবলভাবে মাসুদ রানা প্রভাবিত ছিলেন। নিজেকে বলতেন রাহাত খান। আর আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়ার সময় বলতেন মাসুদ রানা। লাল মোরগের মতো মোটরসাইকেল দাবড়ে বেড়াতেন। পরনের জিন্সের মতো তার গদ্যও ছিলো টানটান। আর সাহস ছিলো সত্যিকারের মাসুদ রানার মতোই।

পরিচয়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে আমাকে একটি অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন, সঙ্গে একটি মিনি টেপরেকর্ডার। অ্যাসাইনমেন্টের গল্প বলার আগে পরিচয়ের গল্পটা একটু বলে নেই। সালটা ১৯৮৯। আমি মাত্র ঢাকা এসেছি। চোখে স্বপ্ন সাংবাদিকতা করবো। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই ঢাকায় কাউকে চিনি না। একদিন সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম, মিনার মাহমুদ ‘সানন্দা’ নামে একটা পত্রিকা করবেন। কয়েকজন তরুণ খুঁজছেন। ততোদিনে তিনি সাপ্তাহিক ‘বিচিন্তা’ সম্পাদনা করে নিষিদ্ধ হয়ে, জেল খেটে গোটা দেশেরই হিরো, রাগী তারুণ্যের প্রতীক।
আমার মেসমেট মিথুন কায়সারকে নিয়ে অনেক খুঁজে গেলাম দিলু রোডের হোটেল লর্ডসে (ভবনটি এখনও আছে, সম্ভবত সমাজকল্যাণের কোনো একটা অফিস) ঢুকে নিচতলার বাঁদিকের একটা রুমে একজনকে পেলাম। দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘আমি মিনার।’ আমি তো তখন বাকরুদ্ধ। আমার সামনে টেবিলের ওপাশে মিনার মাহমুদ! অবিশ্বাস্য। সত্যি বলছি, দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে এতোটা শিহরিত কখনো হইনি। যতোবার লিখি, ততোবার শিহরণটা ফিরে আসে। তিনি আমাদের বললেন, কেন সাংবাদিকতা করতে চাই, তা লিখে আনতে। দু’দিন পর লিখে জমা দিলাম। তারপর অপেক্ষার পালা। ডাক এলো মিথুনের।

হতাশ আমি আবার গেলাম। গিয়ে রীতিমতো চাপাচাপি করলাম, আমাকে নিতেই হবে। তখনই অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ মিনার মাহমুদের নামে কিছু করতে দেবেন না বলে ‘সানন্দা’ প্রকল্প ভেস্তে গেলো। তার দেয়া অ্যাসাইনমেন্টটি ছাপা হয়েছিলো পাক্ষিক অনন্যায়, সেটিই ছিলো আমার প্রথম রিপোর্ট। ফুটপাথে আসর জমিয়ে সব রোগের ঔষধ বিক্রি করা নিয়ে ছিলো সেটি। বলছিলাম মিনি টেপরেকর্ডারের কথা। তখন ঢাকায় আমি চালচুলোহীন। মেসে থাকি। আর মিনি টেপরেকর্ডার তখন মহার্ঘ্য। মিনার মাহমুদ দু’দিনের পরিচয়েই আমাকে সেটা দিয়ে দিলেন। পরে শুনেছি, এটাই তার স্টাইল। প্রয়োজনে কাউকে ক্যামেরাও ধরিয়ে দিতেন, কাউকে টাকা। এমন অনেকে নাকি ফিরে আসেননি। তবুও মিনার মাহমুদ তার স্টাইল বদলাননি। বিশ বছর পর যখন তাকে সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছি, তিনি অট্টহাসিতে ঘর ফাটিয়ে বলেছেন, যারা আসেনি, ক্ষতি তাদের হয়েছে। মানুষকে বিশ্বাস করে আমি ঠকিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময়েই সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় ফাটাফাটি সব রিপোর্ট করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। মোংলার চোরাচালান নিয়ে করা ‘অপারেশন মোংলা’ পড়ে বিশ্বাস করলেন না তখনকার দোর্দ- প্রতাপশালী স্বৈরশাসক এরশাদ। হেলিকপ্টারে মিনার মাহমুদকে নিয়ে এরশাদ গেলেন মোংলায়। দেশের রাষ্ট্রপতি একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে নিয়ে হেলিকপ্টারে ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন। এরপর কী হতে পারতো? আরো অনেকের মতো তিনিও স্বৈরাচারের অনুগ্রহে আয়েশী সাংবাদিকতা করতে পারতেন। কিন্তু মিনার মাহমুদ করলেন উল্টোটা। ১৯৮৭ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সেই সম্পাদক বনে গিয়েছিলেন সংবাদপত্রের ইতিহাসের বাঁক বদলকারী প্রকাশনা সাপ্তাহিক ‘বিচিন্তা’ দিয়ে। ৩২ পৃষ্ঠার এই সাপ্তাহিক কাঁপন ধরিয়েছিলো স্বৈরাচারী এরশাদের মসনদে। ‘বিচিন্তা’র সার্কুলেশন ছিলো এক লাখ ৮৬ হাজার! জি, ভুল পড়েননি, ৮৭ সালে বাংলাদেশের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সার্কুলেশন ছিলো এক লাখ ৮৬ হাজারই। ভীত এরশাদ ‘বিচিন্তা’ বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি, জেলে পুরেছেন মিনার মাহমুদকে।

১৯৮৭ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘বিচিন্তা’ ভেঙে দিয়েছিলো সাংবাদিকতার প্রচলিত সব রীতিনীতি, নিয়মকানুন, শৃঙ্খল। সত্যের এমন কঠিন আর চাঁছাছোলা প্রকাশে চমকে গিয়েছিল সবাই। তখনকার সাংবাদিকতার মূলধারার সবাই ‘বিচিন্তা’কে পোলাপাইনের শখ আর বেয়াদবি বলে অবজ্ঞা করেছিলেন, উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। নিয়মকানুন না মানা, স্মার্ট, আধুনিক সাংবাদিকতার সেই ক্ষীণ ধারাটিই পরে খবরের কাগজ হয়ে দৈনিক আজকের কাগজে অনেকটা সুশৃঙ্খল মাত্রা পেয়েছিলো। আজকে যেটি সাংবাদিকতার মূলধারা, সেটির একটি উৎস অবশ্যই ৩২ পৃষ্ঠার ‘বিচিন্তা’।

এরশাদ পতনের পর আবার ‘বিচিন্তা’ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু একটি রিপোর্টের কারণে দেশজুড়ে আটাশটি মামলায় হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত মিনার মাহমুদ। তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে তার সংসারও তখন ভেঙে গেছে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত মিনার মাহমুদ চলে গেলেন আমেরিকায়। তেপান্ন বছরের জীবনের আঠারো বছরই অপচয় করলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে এই ছোট্ট জীবনও সাংবাদিকতা করে, ফটোগ্রাফি করে, গল্প-উপন্যাস লিখে পূর্ণ করে গেছেন। অনেকে এর চেয়ে অনেক লম্বা জীবন পান, কিন্তু সেটা এতো বড় হয় না।

স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের দেশ আমেরিকা আঠারো বছরে কেড়ে নিয়েছিলো মিনার মাহমুদের অনেক কিছুই। কারাবাসের ভয়ে দেশ ছেড়েছিলেন মিনার মাহমুদ। কিন্তু গিয়ে আঠারো বছর অপচয় করে এলেন তালাবিহীন বড় কারাগারে। আসলেই অপচয় করলেন। প্রতিভার অপচয় তো বটেই, আঠারো বছর যুক্তরাষ্ট্রে থেকে আসা কারও ব্যাংক ব্যালান্স যখন চার হাজার টাকা হয়, জাগতিক অর্থেও সেটা চরম অপচয়ই। অনেকের জন্যই স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র মিনার মাহমুদের কাছে ছিলো স্বপ্নভঙ্গের দেশ, দুঃস্বপ্নের দেশ।

মিনার মাহমুদের আত্মহত্যার পর নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি, আর কী করতে পারতেন তিনি? একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগের দিন ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, ‘আজকের প্রত্যাশা’র চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।’ আজকের প্রত্যাশার সম্পাদক হওয়ার চেয়ে মিনার মাহমুদের মরে যাওয়া অনেক ভালো। মিনার মাহমুদ তো আমাদের মতো নন। মিনার মাহমুদ অন্য রকম। কেরানীর মতো ৯টা-৫টা অফিস করবেন, উত্তরায় নির্বাসিত জীবনযাপন করবেন, বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন এমনটা মিনার মাহমুদের কাছে আশা করাই অন্যায়। তার ভেতরে আগুন ছিলো, আশির দশকেই তা টের পেয়েছে সবাই। আঠারো বছর সে আগুন চাপা ছিলো। দেশে ফিরে সে আগুনে পোড়াতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকতার নামে আমাদের সব ভ-ামি, কূপম-ুকতা, অসততা আর তথাকথিত ঠাটবাট। পারেননি। তিনি একা হয়ে গিয়েছিলেন। আমরাই যে এখন সংখ্যাগুরু। তাই উল্টো নিজেই পুড়ে গেলেন। আমরা মানে মিনার ভাইয়ের মাসুদ রানারা যখন আপসের চোরাবালিতে হারিয়ে ভিলেন হয়ে যাই, রাহাত খানের তো তখন মরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।

আঠারো বছর আমেরিকায় গুহামানবের জীবনযাপন শেষে দেশে ফিরে শুরু করেছিলেন ‘বিচিন্তা’র তৃতীয় ইনিংস। তবে করপোরেটদের দখলে থাকা আজকের বাণিজ্যিক সাংবাদিকতার এই সময়ে মিনার মাহমুদ ছিলেন একেবারেই আনফিট। তাই তো ‘বিচিন্তা’র তৃতীয় ফ্লাইটের অনিবার্য পরিণতি ছিলো ক্র্যাশ ল্যান্ডিং। মিনার মাহমুদের হাতে গড়া সাংবাদিকদের অনেকেই তখন তারকা, জাতির বিবেকের দায়িত্ব পালন করেন প্রায় প্রতিদিনই। এ নিয়ে তার গর্ব ছিলো।

দেশে ফিরে মিনার মাহমুদ চেয়েছিলেন সাংবাদিকতা করতে। কিন্তু সেটা তার মতো করে। বাণিজ্যের পেটে ঢুকে যাওয়া, বিজ্ঞাপনের জন্য সম্পাদকের ধরনা, বিজ্ঞাপনদাতার সব অন্যায় মুখ বুজে সয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীর মতো আচরণ করা, সাংবাদিকতার প্রভাব খাটিয়ে বিত্তশালী হওয়া এমন সাংবাদিকতা মিনার মাহমুদ কখনোই চাননি, কখনও করেননি।

অনেকেই জানতে চেয়েছেন মিনার ভাই কেন আত্মহত্যা করলেন। আমি জানি না। আমি জবাব খুঁজি জীবনানন্দের ভাষায়, ‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় আরো এক বিপন্ন বিস্ময়, আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে, আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত ক্লান্ত করে, লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নেই, তাই লাশকাটা ঘরে চিত হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ওপর।’

শুরুতে যেমনটা বলেছি, মিনার ভাই নেই, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। আসলেই হয় না। মিনার ভাই তো আছেনই আমাদের চিন্তায়, মননে। মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়