সালেক খোকন : ২৫ মার্চ ১৯৭১। গোটা দেশের প্রধান শহরগুলো পাকিস্তানি আর্মিরা দখলে নেয়ার চেষ্টা করে। তারা আর্মি ও ইপিআর ব্যারাকে হামলা চালায় বাঙালি সদস্যদের ওপর। ফলে অনেকেই ব্যারাক থেকে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসে। তখন নেতাদের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরেই নানা কাজে যুক্ত ছিলেন শফিউল বশর ভা-ারীরা। অন্যদিকে সীমান্তের বিওপিগুলোতে পাঞ্জাবী সদস্যদের নিধন করে ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের দিকে চলে আসে। তাদের খাবার দিতে এগিয়ে যান মহিউদ্দিন চৌধুরী, মুসলেম উদ্দিন, ইউনুস প্রমুখ। কিন্তু ষোল শহরে এইট বেঙ্গল ক্যাম্পের দিকে আসতেই স্টেডিয়ামের পাশের ব্যারাকে থাকা নেভালরা তাদের বন্দি করে।
শফিউলরা তখন কর্ণফুলী পার হয়ে আনোয়ারা, পটিয়া দিয়ে নারায়ণ হাট হয়ে রামগড়ে পৌঁছান। সেখানে জেনারেল জিয়া ও শওকত আলীর নেতৃত্বে ভারতের বিএসএফ ক্যাম্প বাগাফায় তাদের সাত দিনের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এলএমজি পর্যন্ত চালানো শেখায় সেখানে। অতঃপর আর্মিদের সঙ্গেই নিয়মিত যুদ্ধে অংশ নেন তারা। কড়েরহাটে একটা ব্রিজ ড্যামেজ অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনারা তিনদিক থেকে তাদের ওপর প্রচ- আক্রমণ চালায়। ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় সবাই। আপনারা তখন কী করলেন? ‘ফেনী নদী পার হয়ে চলে যাই সাবরুম সাব ডিবিশনাল হেড কোয়ার্টারে। পরে হরিণা নামক জায়গায় একটা ক্যাম্প করে থাকি। বিএলএফ তখন গঠিত হয়েছে। যা মুজিব বাহিনী নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু আমরা এর কিছুই জানি না। আগরতলার কলেজ টিলায় ছাত্র নেতারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের খুঁজে খুঁজে বিএলএফে যুক্ত করতে থাকেন। ছাত্রলীগ করতাম। তাই আমাকেও আনা হয় আগরতলায়।’
আগরতলা থেকে শফিউলদের নেয়া হয় ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি দেরাদুন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে তানডুয়ায়। সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ চলে পৌনে দুই মাস। হাসানুল হক ইনু, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, কাজী আরিফ আহমেদ, মার্সাল মনি, আ ফ ম মাহবুবুল হক, ড. আফতাব, মাহমুদুর রহমান বেলায়েত প্রমুখের সঙ্গে দেখা হয় সেখানেই। ট্রেনিং করায় ইন্ডিয়ান আর্মির প্যারা ট্রুপার্স কমান্ডো ডিভিশন। মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান ছিলেন দায়িত্বে। ডোবরা নামে একজন বিগ্রেডিয়ারও ছিলেন। শফিউলরা ছিলেন বিএলএফের প্রথম ব্যাচের যোদ্ধা। ট্রেনিং শেষে তাদের করণীয় ব্রিফ করেন মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের এম এ মান্নান, ট্রেনিং শিক্ষক ও পরিচালক পিএসসি পুরকায়স্থ এবং মেজর মালহুতরা।
অস্ত্র দেয়া হয় কোথায়? তিনি বলেনÑ‘উদয়পুর ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে অস্ত্র পাই। অতঃপর ফেনীর ছাগলনাইয়া দিয়ে দেশের ভেতর ঢুকি। প্রথমে বুরবুরিঘাট দিয়ে মিরেরসরাই, সেখান থেকে শীতাকু-, এরপর চট্টগ্রাম শহরে আসি। দশজনের দল ছিলো। কমান্ড করতেন আব্দুল্লাহ আল হারুন। আরও ছিলেন ডা. আমিন আহমেদ, ডা. জাফরুল্লাহ, ডা. মাহবুব প্রমুখ। গেরিলা ছিলাম। নির্দেশ ছিলÑ‘টু হিট অ্যান্ড রান’। ভীতি তৈরি করাই ছিলো প্রধান কাজ।’মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন শফিউল বশর।
পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে রক্তাক্ত হয় তার ডান পাশের হিপ, ডান হাতের কনুইয়ের নিচ ও ডান পায়ের পাতা। তাকে ধরে নিয়ে টর্চারও করে পাকিস্তানি সেনারা। রক্তাক্ত সে ইতিহাস শুনি এই বীরের জবানিতেই। তার ভাষায়Ñ‘সাবেক সংসদ সদস্য সুলতানুল কবির চৌধুরী বাঁশখালীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন তখন। বাঁশখালী, বোয়ালখালী, রাউজান প্রভৃতি অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন নানা খরচে আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন। এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা চলে। কীভাবে এই অর্থ সংগ্রহ করা যায়? খবর আসে চট্টগ্রাম স্টেট ব্যাংক থেকে কাস্টমসের মাসিক সেলারির টাকা যাবে একটা মাইক্রোতে। নির্দেশ দেয়া হয় সেটি ছিনিয়ে নেয়ার। আমরা চারজন, একটা ফিয়েট গাড়িতে। আমি, রফিক, অমল ও ফজলু। ড্রাইভার ছিলো ভোলানাথ। আশপাশে আরও কয়েকটি গ্রুপ। আগ্রাবাদে একটি সেল্টার থেকে বের হই আমরা।
ইনফরমেশনটা ভুল ছিলো। ফলে ব্যাটে বলে মিলে না। আমরাও গাড়িটি পাইনি। তাই অপারেশনটা হলো না। ফলে আবার সেল্টারেই ফিরে যেতে হবে। কিন্তু রফিক রাজি হয় না। কোনো একটা অপারেশন সে করবেই। তাই আমরা ঘুরছি শহরে। সঙ্গে ছিলো দুইটা এসএমজি, চারটা রিভালবার আর চারটা গ্রেনেড। পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম টর্চারের কথা বলতে গিয়ে অঝরে কাঁদেন এই বীর যোদ্ধা। তার অশ্রুসিক্ত বয়ান আর কষ্টের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের বুকের ভেতরটাকেও খামছে ধরে। আমরা তখন নীরব থাকি। নিজেকে সামলে নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিউল বশর আবারও বলতে থাকেনÑ ‘পা-টা তখন ট্রাকশন দেয়া। আর্মিরা আমাকে কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে নিয়ে আসে।
সেখানে চলে সিভিয়ার টর্চার। মিলিটারি অফিসাররা এসেই পরিচয় জানতে চায়। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শুনলেই বুকেপিঠে প্রচ- চাপ দিয়ে ধরে। তখন মনে হতো আর বাঁচবো না। মায়ের মুখটা মনে ভেসে উঠতো। একের পর এক গ্রুপ আসে আর জিজ্ঞাসাবাদ চলে। থেমে থেমে চলে ইলেকট্রিকশক। মুক্তিযোদ্ধাদের শেল্টারগুলোর অবস্থান, লিডার কারা, আমার পরিচয় কিÑটর্চার করে ইন্টেলিজেন্সের লোকেরা এগুলো জানতে চাইতো।’ ছাড়া পেলেন কীভাবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেনÑ‘ভাগ্য বলতে পারেন। চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নামকরা প্রবীণ প্রিন্সিপাল ছিলেন এ এ রেজাউল করিম চৌধুরী। উনি পাকিস্তানি মতাদর্শে বিশ্বাসী, নেজামে ইসলামীর সমর্থক ছিলেন। ওই কলেজে পড়েছি শুনে আর্মির লোকেরা তার কাছে যায়। উনি জানতেন আমি ছাত্রলীগ করি। কিন্তু বেমালুম এই তথ্যগুলো চেপে গেলেন। আর্মিদের বললেন, ‘ও আমার কলেজের সবচেয়ে নিরীহ ছাত্র।’ তার ওই তথ্যের কারণেই ছাড়া পাই। দেশ যখন স্বাধীন হয় আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেলে।
পা নাড়াতে পারি না। কষ্ট ছিলো খুব। কিন্তু মুক্তির আনন্দে সব ভুলে গিয়েছিলাম!’
মুক্তিযোদ্ধা শফিউল বশরের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রেডিওতে জিয়ার ঘোষণা সম্পর্কে তার ভাষ্যÑ‘স্কুল ছুটি দেয় হেডমাস্টার। আর ঘণ্টা বাইড়ায় দপ্তরি। এখন কী কোনো পাগল বলবে দপ্তরি ছুটি দিছে?
রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার শাসনামলের তুলনা করেন এই বীর যোদ্ধা। বলেনÑ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। তবে আমার কাছে রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু গ্রেটেস্ট আর শেখ হাসিনা হলেন লেটেস্ট।’ স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শফিউল বশর বলেনÑ‘দেশের অর্থনীতি আর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট দেখলে বেশি ভালো লাগে। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ছিলো স্বাধীনতার স্বাদ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া– সেটা খুব সাকসেসফুল হচ্ছে। মানুষ অতীতের চেয়ে অনেক ভালো আছে। জাগরণ ঘটেছে। মানুষ স্বপ্ন দেখা শিখেছে। এগুলো দেখলে তৃপ্ত হই।’
খারাপ লাগে কখন? ‘পাকিস্তান আমলে বাইশ পরিবারের প্রতি আমাদের অনীহা ছিলো। অথচ আজ বাংলাদেশে নতুন করে লুটেরা বাইশ হাজার পরিবারের জন্ম হয়েছে। সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে অল্প কিছু মানুষের কাছে। এটা কষ্ট দেয়।’ কী করা উচিত? তার মতÑ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি খাতে কম দেয়া। গরিব দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বিষফোড়া। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আমার বিশ্বাস শেখ হাসিনার হাত দিয়েই তা ঘটবে। তবে বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতিও আমাদের আস্থা রাখতে হবে।’ পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরেই একসময় এ দেশটা উন্নত বাংলাদেশ হবে। তবে প্রজন্মকে অবশ্যই গাইড করতে হবে। এমনটাই মত দেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শফিউল বশর ভা-ারী। প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেনÑ‘দেশ একটা সত্তা। আর সে সত্তায় তোমরাই মূল শক্তি। দেশের বীরত্বের ইতিহাসগুলো মনে রেখ। ধর্মের আফিম থেকে নিজেকে মুক্ত রেখো। ধর্মের কারণে কখনও মিসগাইড হইও না। মনে রেখো, মানুষের কল্যাণ আর মুক্তির জন্যই ধর্ম। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি আল্লাহও পছন্দ করেন না।’ লেখক : লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :