আরিফ জেবতিক
রূপকথার সেই দৈত্যের কথা আমরা সবাই জানি। তার খাওয়ার জন্য প্রতিদিন একজন মানুষকে গুহায় রেখে আসতে হতো, নইলে সে সবার সর্বনাশ করে ফেলবে। রাজার সেনারা তাই প্রতিদিন অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায় আর সিদ্ধান্ত দেয় আজকে কাকে গুহায় রেখে আসা হবে। আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা হচ্ছে সেই মানুষ খেকো দৈত্য। আমাদের রাজার সেনারা প্রতিদিন আমাদের কাউকে না কাউকে সেখানে বলি দেয়ার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। কারণ সেই মানুষের রক্ত-মাংসের ভোগে সেই দৈত্যের সাথে রাজার সেনাদেরও ভাগ আছে। পরিবহন ব্যবস্থা পুরোটাই চলছে মাফিয়া চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে। আপনি দেখবেন যে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি আর মোটরসাইকেলের ওপর সকল নিপীড়ন, কিন্তু বাস-ট্রাক-মিনিবাস-টেম্পু-লেগুনার সাতখুন মাপ।
ধরুন আপনার গাড়িতে অন্যায়ভাবে একটা বাস কি ট্রাক ঘষা লাগিয়ে দিলো। আপনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার কোনো সাহায্য পাবেন না। উনারা স্পটে এসে গড়িমসি লাগিয়ে দেবে। তারপর ধমক দিয়ে একটা নামকা ওয়াস্তে কয়েকশো টাকার ক্ষতিপূরণ আপনার জন্য দিতে পারে নয়তো বলবে গরিব মানুষ, এদেরকে ছেড়ে দিন।
এই যে গরিব মানুষের প্রতি এদের দয়া এটা এমনি এমনি নয়। সবগুলো কোম্পানি/ সমিতি মাসে মাসে প্রতিটি গাড়ি হিসেবে টাকা দেয়। সেই টাকা নিচ থেকে উপর পর্যন্ত বহু টেবিলে ভাগ হয়। এটা এক ধরনের বীমা পলিসির মতো। এর বিনিময়ে রাস্তায় এরা সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকে। সৎ অফিসার যে নেই তেমন নয়, তবে সেই সৎ অফিসাররাও এই সিস্টেমের কাছে অসহায়।
সব লাইসেন্স চেকিং আর কাগজপত্র চেকিং হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়িতে। এই কাগজপত্রগুলোও যদি সঠিক পরীক্ষা দিয়ে পাওয়ার দরকার হতো তাহলে কথা ছিলো না। আমি আমার পরিচিত একজনকেও পাইনি যে পরীক্ষা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছে। ¯্রফে টাকা দিয়ে দিলে লাইসেন্স পাওয়া যায়, গাড়ি না দেখিয়ে ফিটনেস নেয়া যায়। অথচ আমি ইংল্যান্ডে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়ার সময় দেখেছি ওদের কী পরিমাণ কড়াকড়ি। থিওরি শিখতেই অনেক সময় পার হয়ে যায়। এতে করে জিনিসগুলো একেবারে অভ্যাসে চলে আসে, ব্রেনে স্থায়ীভাবে বসে যায়। ওখানে কেউ একবারে লাইসেন্সের পরীক্ষা পাস করলে শিন্নি দেয়ার মতো সেলিব্রেট করে। তারপর রাস্তায় আইন প্রয়োগের কড়াকড়ি তো আছেই। আমি আর আমার এক বন্ধু একবার পোর্টসমাউথে এক বাসার সামনের ডাবল লাইনে রাত সাড়ে ৯টার সময় গাড়ি পার্ক করে ভেতরে গেছি। চারপাশ শুনশান নীরব। কিন্তু বেরিয়ে দেখি ঠিকই ফাইনের টিকিট কে যেন দিয়ে গেছে গাড়ির বনেটে।
আমাদের অনেক ধান্দাবাজ লোকজন বলে থাকেন যে আমাদের দেশের ড্রাইভাররা লেখাপড়া জানে না, তাদের আইন শেখানো খুবই চ্যালেঞ্জিং। ব্যাপারটা মোটেও তা নয়, এসবই হলো দুর্নীতির টাকা খাওয়ার অজুহাত। আপনি দেশে একজন ড্রাইভারও পাবেন না যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গেলে নির্দিষ্ট গতিসীমার উপরে গাড়ি চালাবে। সবাই একেবারে ভদ্র বালক হয়ে লাইন মেনে গাড়ি চালায়। কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরুলে সেই একই ড্রাইভার এখানে সেখানে তেছরা করে গাড়ি রেখে লোক তুলতে থাকবে। এরা মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে পারে আর সামান্য কিছু আইনকানুন শিখতে পারবে না, এমনটা হতেই পারে না। অনেকে বলে পাবলিক আইন মানে না। আমাকে বলেন, যদি জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি না থামে তাহলে লোকজন এলোমেলো দৌড়ে রাস্তা পার হওয়া ছাড়া কী করবে! যদি বাস নির্দিষ্ট স্থানে না থামে তাহলে পাবলিক তো অনির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়েই বাসে উঠবে। খাসলত খারাপ এমন মানুষের সংখ্যা অবশ্য কম নেই, যারা পাশেই ওভারব্রিজ রেখে রাস্তার মাঝ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে রোড ডিভাইডার ডিঙিয়ে রাস্তা পার হবে। কিন্তু ওভারব্রিজ যেখানে নেই, সেখানে রাস্তা পার হওয়ার জন্য নিরাপদ কোনো উপায়ই নেই। দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থার অরাজকতা বন্ধ করতে হলে কী কী করতে হবে সেটা নিয়ে কমিটি গড়ে বস্তা বস্তা রিপোর্ট দেয়ার কিছু নেই। করণীয় কী এটা কর্তাব্যক্তিরাও জানে। কিন্তু পেটভর্তি হারাম টাকা থাকলে সেই করণীয়গুলো মগজে কোনো বিকার তৈরি করে না।
লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিটস। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :