শিরোনাম
◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী 

প্রকাশিত : ২১ মার্চ, ২০১৯, ০৪:২৩ সকাল
আপডেট : ২১ মার্চ, ২০১৯, ০৪:২৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ধর্ষণ : অপ্রতিরোধ্য, প্রতিকারহীন

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম

ধর্ষণের প্রাদুর্ভাব মানব অবির্ভাবের সমান পুরানো হয়তো বা। দেহবলে সবল পুরুষেরা দুর্বল নারীদের ধর্ষণ করে। এ জন্য বাংলা ভাষায় এর আর এক নাম বলৎকার। সভ্য সমাজ এই হীনতম অপরাধকে লাগাম পরিয়েছে। কঠোর আইন আর তার কঠোরতম প্রয়োগের মাধ্যমে। ইউরোপ আজ নারীদের জন্য নিরাপদ। গভীর রাত, পার্কে, রাজপথে একা নারী, গ্রীষ্মে তো স্বল্পবসনা। এই হচ্ছে সেখানকার চিত্র। কিন্তু ধর্ষণভীতি নেই এ চিত্র উপমহাদেশেও দুর্লভ নয়। পর্যটনের স্বর্গভূমি নেপালে এ দৃশ্য দেখেছি। রামায়নে রাক্ষস অধ্যুষিত বলে কথিত মিথের লঙ্কায়ও তা দেখেছি। ভারতে ধর্ষণের ব্যাপকতা আছে বটে, কিন্তু এই সিলেটের বর্ডার পেরিয়ে আসামে ঢুকলেই চোখে পড়ে অন্য এক চিত্র। স্বাধীন মেয়েরা সহজে বেড়াচ্ছে রাতের বেলাও। বন-প্রান্তর-পাহাড়েও একই অবস্থা। বিপরীতে কি অবস্থা আমাদের দেশে?

১৭ মার্চ রোববারের ঘটনা। ঢাকা-সিলেটগামী বাস বিকল হয়েছে পথে নরসিংদীর এক পয়েন্টে। ৪৮ বছর বয়স্কা মা ২৪ বছরের মেয়েকে নিয়ে রিকশায় এগুচ্ছেন, অন্য বাস খুঁজতে। হঠাৎ ধর্ষক এসে গেলো। মেয়েটিকে নামিয়ে টেনে নিতে শুরু করলো নিকটস্থ পাটকলের পরিত্যক্ত ঘরে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় মাতা কন্যাকে বাঁচাতে ছুটলেন পিছু পিছু। ভাগ্যবান ধর্ষকরা মেয়ের সাথে মাকে বোনাস পেয়ে গেলো, বিনা আয়েশে। তারপর মা-মেয়েকে ধর্ষণ করলো ছয় জনে মিলে। ধন্যবাদ পুলিশকে, অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে তৎপর হয়ে দুই জনকে ধরে ফেলেছে। পরে জনগণ আরো এক ধর্ষককে ধরে পুলিশে দিয়েছে। ২২ বছরের ভ্যানচালক। প্রতিবেশির সাত বছরের মেয়েকে নিজ ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করে। মুখ চেপে ধরে। পাষ-ের বলৎকারে ক্ষুদ্রপ্রাণ মেয়েটি মারা যায়। বেশ, ‘জঞ্জাল’টিকে ফেলে দিতে হয়! যে বিছানায় সে ধর্ষণ করছিলো, সেই বিছানার নোংরা কাঁথাটি দিয়ে মুড়ে শিশুর লাশটি পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। মেয়েটির সন্ধান না পেয়ে মাইকিং করছিলো বাবা। ওই ভ্যানওয়ালার ভ্যানেই। (প্রথম আলো, ১৭ মার্চ ২০১৯)।

১৮ মার্চ প্রথম আলোরই আর এক ধর্ষণ ঘটনা রামায়নে বর্ণিত বিরাধ রাক্ষসের কথা মনে করিয়ে দিলো। রাম-শীতা তখন দূর কবনে সদ্য এসেছেন। সাথে লক্ষ্মণ। হঠাৎ বিরাধ নামক এক ঘোরদর্শন রাক্ষস বৃক্ষ থেকে নেমে এসে রাম-লক্ষ্মণকে এই বলে ভর্ৎসান করে, ‘এই ঘোর বনে দুই পুরুষ এই নারীকে নিয়ে পাপাচার করতে কেন এসেছিসরে পামর?’ তারপর সীতাকে কাঁধে নিয়ে বনের মধ্যে  যেতে শুরু করে। প্রিয় ভার্যার এই দুর্গতি দেখে রামের তো মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। ভাগ্যিস লক্ষ্মণ পাশে ছিলেন। তিনি প্রচুর এক খড়গাঘাতে বিরাধের বাহু ছেদন করে সীতাকে রক্ষা করেন। ১৭ মার্চ রোববার টাংগাইলের সখীপুরের ঘটনাটা এ রকম। খেলার মাঠে বসে গল্প করছিলো প্রেমিক-প্রেমিকা। এলাকার পাঁচ যুবক এসে বলে, ‘আমাদের পাড়ায় এই নোংরামি। ছিঃ ছিঃ তোদের সাহস তো কম নয়’। এই বলে তারা দুজনকেই ধরে নিয়ে যায়। পাশের বনে। তারপর প্রেমিকের সামনেই মেয়েটিকে উপর্যপরি ধর্ষণ করে পাঁচ যুবক। শুধু কি ধর্ষণ? ছবিও তোলে ধর্ষণের। বীরের জাতি বীরের দেশ! এই সখীপুরের বনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথা। সখীপুরের পাঁচ বীরপুরুষ তাই ধর্ষণের চিত্রটিও নারীবিজয়ের স্মারক হিসেবে সংরক্ষণ করতে চায় বুঝি ! এটি দেখিয়ে আরো ধর্ষণ করা যাবে ভবিষ্যতে। দুঃখজনক হচ্ছে, আগেও এ মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো। তখন নিতান্ত শিশু। পড়তো ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সে ঘটনায়ও মামলা হয়েছিলো। এরপর থেকে থানা ও আদালতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত শিশুর আর পড়াশোনা হয়নি। বলুন স্বাধীন দেশে নারীর চলাফেরার স্বাধীনতা কোথায়? আমাদের স্বর্গবনিকরা বলেন, বোরখা পরো। সমস্যার সমাধান। কিন্তু বোরখা তো ছিলো ওই মা-মেয়ের। সিলেটের বাসে হবিগঞ্জে যাচ্ছিলেন। কি হলো তাতে? এই যে ইউরোপে স্বল্পবসনা উজ্জ্বল তরুণীরা একাকী দিন-রাত চলাচল করছেন, তাদের তো বোরখা নেই, তবুও ধর্ষণ নেই সেখানে।

সমস্যাটা অন্যত্র। ওদের আইনের শাসন আছে। তাই পুলিশ সরকারের নয়, রাষ্ট্রের। ধর্ষক সত্তর হাত জলের তলে লুকিয়েও রক্ষা পাবে না। পুলিশের ডুবুরি দল তাকে ধরে আনবে। আর একবার বিচারে সোপর্দ করলে বিচার আপন গতিতে চলবে। কঠোর সাজা থেকে নিষ্কৃতি নেই ধর্ষক যদি হয়ে থাকেন, দেশের মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীও।

আর আমাদের? ধর্ষিতার জন্য নেয় বিচার? সে এক সপ্তসিন্ধু তের নদী পাড়ি দেবার ট্রাজিক ব্যর্থতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এ দেশে শতকরা দুই ভাগ ধর্ষণমামলা রায়ের মুখ দেখে। যেগুলো ধামাচাপা দেয়া কঠিন হয়ে যায়, কেবল সে ধরনের মামালা। বাকিগুলো লম্বা তদ্বিরের অভাবে, শক্তিমানের চাপে, পুলিশের অসহযোগিতায় কখনো আর বিচারের মুখ দেখে না। এ ঘটনা সবার জানা, যা উল্লেখ না করলেও চলে। তবে এ মুহূর্তে আমার নাকের ডগায় যে ঘটনা, তা একটু না বলে পারছি না। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় বড় শিরোনাম হয়েছে, ‘বাদী জানেন না পাল্টে গেছে এজহার-ধর্ষণের অভিযোগে মামলা’। বিশ বছর বয়সী সুমন সাত বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। ডাক্তারি রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত মিলেছে। অথচ পুলিশ বলছে ধর্ষণচেষ্টা। ধর্ষকের বয়সও কমিয়ে ফেলেছে। আবার ধর্ষিতার ভাই ধর্ষকের অবস্থান জানালেও সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশ ধর্ষককে ধরতে উদ্যোগ নেয়নি (প্রথম আলো, ১৮ মার্চ ২০১৯)।

পুলিশ এ সাহস কোথা হতে পায়? বেদনার সাথ বলতে হয়, এ সাহস দেয় সরকার। একটি রাষ্ট্রে বিরাধ রাক্ষুসের বাহু ছেদনের দায় যে বাহিনীর, সে বাহিনী এখন আর রাষ্ট্রের নয়, সরকারের। পুলিশ চলে দলীয় নির্দেশে। একে দিয়ে প্রতিপক্ষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়, নির্বাচনে জিতার কাজও করানো হয়। প্রয়োজনে রাতের অন্ধকারে ভোটও কাটানো হয়। থানার ওসি হয়ে যায় এমপির ওসি। আইজিরও তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সাধারণ মানুষ, তাদের অভিযোগ কি মূল্য বহন করে এ সব পুলিশের কাছে? টাকা না দিলে বড় বড় ক্রাইমেরও অভিযোগ নেয় না থানায় এমন অভিযোগ শুনতে, শুনতে, শুনতে, শুনতে আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। তো কোনো দুর্বল ব্যক্তি হাতে-নাতে কোনো ধর্ষককে ধরে যদি থানায় অভিযোগ দিতে যায়, আর ওই ধর্ষক যদি দলীয় ক্যাডার হয়, থানা তার বিরুদ্ধে মামলা নিতে চাইবে না। এর মধ্য যদি এমপি সাহেবের ফোন আসে, ওসি সাহেব! ওর বিরুদ্ধে মামলা নিবেন না। ও আমার ছেলে, তাহলে তো আর কথা নেই।  অনেক সময় ধর্ষণের মামলা নিয়ে পুলিশ অশিক্ষিত বাদির কাছ থেকে কৌশলে সাদা কাগজে সই করিয়ে রাখে। ধর্ষকের সাথে যখন সন্তোষজনক ঘুষের ডিলটি হয়ে যায়, তখন সে মামলা খতমের জন্য সে কাগজ ইচ্ছে মতো ব্যবহার করা হয়। এমন অভিযোগও আমাদের দেখতে হয় পত্রপত্রিকায়। তা হলে কড়া কড়া ধর্ষণবিরোধী আইন করে লাভটা কোথায়? প্রয়োগ করবে কে?

একটা কথা আপ্তবাক্যের মতো প্রায়ই বলা নয়, ধর্মীয় লেবাস ধর্ষণ থেকে নারীকে রক্ষা করতে পারে। এটি ভুল। ধর্মীয় লেবাস পরা মেয়েরা এমন কি মাদ্রাসায় পড়া মেয়েরাও মাদ্রাসার পথে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আর ধর্ম বনিকরা যদিও ধর্মের আলোকে এ সমস্যা সমাধানের নসিহত করেন, কিন্তু তাদের হাতে নিহায়েত ভাগ্যাহত শিশুদের ধর্ষণের হার কম নয়। অভিভাবকহীন শিশুর অবিভাবকত্ব নেয় গীর্জা, মাদ্রাসা, এতিমখানা। ওই ভাষাহীন অসহায় শিশুর অনেকেই গডম্যানদেরই ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুপ্রেমিক এ কথা সত্য। শিশুদের মাঝে তার যে মাতৃসুলভ আচরণ, তা সরল বাঙালি মায়ের অকৃত্রিমতায় ভরপুর। ১৭ মার্চ টুঙ্গি পাড়ায় এক শিশু সমাবেশে তিনি দেশটিকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে সুকান্তের ছাড়পত্র কবিতা আবৃত্তি করেন, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি..’। এ সদিচ্ছার সাফল্যে কেমনে বিশ্বাস করি? ১৯৯৬ সালের আগে বা ২০০১-৫-এ  খালেদা জিয়ার সরকারে পুলিশ যেমন ছিলো, এখন তেমন আছে। কোনো পালাবদল হয়নি সেখানে। আজও তারা  সরকারের, রাষ্ট্রের নয়। এমপি-মন্ত্রীর কথায় আগেও উঠতো-বসতো, এখনও তাই করে। জনগণের পালাবদলের স্বপ্ন কি শুধু উন্নয়ন? না ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, ভোটধিকার, নাগরিক অধিকার? দলীয় পুলিশের দেশ কখনো শিশুর বাসযোগ্য হবে না। হতে পারে না। এ সত্য উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়