প্রভাষ আমিন : আট মাস আগে রাজধানীর রমিজউদ্দিন স্কুলের দুই শিক্ষার্থী মিম আর করিমের মৃত্যুর পর ফুঁসে উঠেছিলো বাংলাদেশ। শুধু ঢাকা নয়, নিরাপদ সড়কের দাবিতে সে আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিলো সারাদেশে। মনে করার কোনো কারণ নেই, এই দুই শিক্ষার্থীই সড়কের মৃত্যু ফাঁদে আটকে পড়া প্রথম। বরং এভাবে বলা ভালো, আপনি সৌভাগ্যবান বলে বাইরে বেরিয়েও নিরাপদে ঘরে ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ সড়কে হত্যার শিকার হচ্ছেন। প্রতিদিনই লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। সড়ক দুর্ঘটনার নামে প্রতিদিন রাজপথে যা হয়, তা আসলে দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকা-। দুয়েকটা হয়তো সত্যি সত্যি দুর্ঘটনা আছে; তবে অধিকাংশই চালকের খামখেয়ালী, অবহেলা, অজ্ঞতা, আইন না মানার প্রবণতা আর প্রতিযোগিতার কারণে ঘটে। ১৯ মার্চ, মঙ্গলবার প্রগতি সরণীতে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পেরুতে গিয়ে রেহাই পাননি আবরার হোসেন চৌধুরী। দুই বাসের প্রতিযোগিতায় সাদা কালো জেব্রা ক্রসিং আবরারের রক্তে লাল হয়ে যায়।
সব মৃত্যুই বেদনার। তবে কিছু কিছু মৃত্যু আমাদের ছুয়ে যায়, আমাদের শহুরে মধ্যবিত্তের নিরাপত্তা ভাবনায় প্রবল আঘাত করে। তখন আমরা ভাবি, মৃত্যু তো আমাদের দোরগোড়ায়। মিম, করিম বা আবরার তো আমারও সন্তান হতে পারতো। তখনই আমরা কাঁদি, প্রতিবাদ করি। কিন্তু আমাদের সকল কান্না, প্রতিবাদ, বিক্ষোভই আসলে অরণ্যে রোদন। আট মাস আগে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে, রাস্তায় নেমে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো দেশটা কিভাবে চলবে। আমরা সবাই বলছিলাম, ছোট ছোট শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু আসলে আমাদের চোখ খোলেনি। আমরা সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই তো সড়ক নিরাপদ হয়নি।
সড়ক কিভাবে নিরাপদ হবে, এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেক গবেষণা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রথম কথা হলো, রাস্তায় নামার আগে গাড়িটি ফিট কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। চালক শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত, মানবিক কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। আর চালক যখন জানবেন, যতো বেশি ট্রিপ, ততো বেশি টাকা; তখন তাকে প্রতিযোগিতা থেকে নিবৃত করা কঠিন। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে না পারলে, চালকদের আইন মানতে বাধ্য করতে না পারলে সহানুভূতি জানিয়ে, বক্তৃতা দিয়ে, কান্নাকাটি করে কোনো লাভ হবে না। কেউ মারা গেলেই ফুটওভার ব্রিজের ঘোষণা আসবে। সারাদেশ ফুটওভার ব্রিজে ভরে যাবে, কিন্তু মৃত্যুর মিছিল থামবে না। এখন আমাদের আসলে নন্দলালের মতো ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
‘নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিশন’ হয়;
হাঁটিতে সর্প, কুক্কুর আর গাড়ি-চাপা-পড়া ভয়,
তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল
সকলে বলিল- ভালো রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।’
লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
আপনার মতামত লিখুন :