শিরোনাম
◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ জিয়াউর রহমানের সময়ই দেশে বিভেদের রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়: ওবায়দুল কাদের  ◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল

প্রকাশিত : ১৮ মার্চ, ২০১৯, ০৩:৫১ রাত
আপডেট : ১৮ মার্চ, ২০১৯, ০৩:৫১ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

যে স্মৃতি চিরদিনই হৃদয়ে বহন করবো

ড.সেলিম জাহান : ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। আগামী বছরই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মানুষটির জন্মশতবার্ষিকী। অর্থাৎ বেঁচে থাকলে ২০১৯ এ বঙ্গবন্ধুর বয়স হতো ৯৯ বছর। ফিদেল ক্যাস্ট্রো একবার বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি’। বিন¤্র চিত্তে আমি বলি, ‘আমি হিমালয় দেখেছি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।’
আমাদের প্রজন্মের বহুজন বঙ্গবন্ধুকে বহুবার দূর থেকে দেখেছেÑ জনসভায় তিনি অনলবর্ষী ভাষণ দিচ্ছেন, সভায় অংশ নিচ্ছেন ব্যক্তিত্বপূর্ণ বিভায়, জনতার মাঝে উপস্থিত মায়াময় আচরণে। বড় নমিত চিত্তে বলি, আমি তাকে একবার কাছে থেকে দেখেছিÑ একবারই কিন্তু খুব কাছে থেকে এবং তিনি আমার সঙ্গে কথাও বলেছেন। স্বল্প ক’টি কথা, তবু বঙ্গবন্ধুর বাক্য তো।
বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামাল ছিলো আমার সতীর্থ সহপাঠী এবং পরম ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। বিভাগ এক ছিলো না আমাদেরÑকামাল সমাজবিদ্যার, আমি অর্থনীতির। কলাভবনের একতলায় সামনের দিকে ওরা, আমরা তিনতলায় পেছন দিকে। তবু নানা কারণে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিলো, জন্মেছিলো ঘনিষ্ঠতাও। সত্তর দশকের প্রথমার্ধে বহু সময় আমাদের একত্রে কেটেছে গল্পে আর আড্ডায়। আমরা আড্ডা বসাতাম গ্রন্থাগারের চাতালে, সমাজবিদ্যা বিভাগের সামনের বারান্দায়, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সবুজ মাঠে। নানা বিভাগের বন্ধু-বান্ধবরা আসতো সেসব আড্ডায়। কথা, চা-পানে, তর্কে-বিতর্কে কখন যে সময় পেরিয়ে যেতো, তা টেরও পেতাম না।
সেদিনও গ্রন্থাগারের চাতালে তুঙ্গ আড্ডা দিতে দিতে কখন যে দুপুর পেরিয়ে গেছে টেরও পাইনি। মাটিতে এলিয়ে পড়া বেড়ালের মতো নরম রোদের সূর্যের দিকে তাকিয়ে আড্ডাধারীরা সব লাফিয়ে উঠলাম। উঠতে হবে এবং যেতে হবেÑছাত্রাবাসে ও বাড়িতে। প্যান্টের ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে কামাল জিজ্ঞেস করলো, ‘হলে গিয়ে তো খাওয়া পাবি না এখন। খাবি কোথায়?’ ‘পপুলারে চলে যাবো’ মৃদুস্বরে বলি আমি। পপুলার রেস্তোরাঁ সময়ে-অসময়ে আমাদের খাবারের অন্যতম শেষ ভরসা। ‘না, এ অবেলায় পপুলারে যেতে হবে না। আমাদের ওখানে চল্, যা আছে দু’জনে ভাগাভাগি কর খাবো।’
এইটাই ভয় করছিলাম। এতো বন্ধুত্ব সত্ত্বেও ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটিতে আমি যেতে চাইতাম না। অন্য কিছু নয়, শুধু মনে হতো, ঐ বাড়িতে গেলে যদি বঙ্গবন্ধুর সামনাসামনি পড়ে যাই এবং তখন যদি আমি ঠিকমতো আচার-আচরণ না করতে পারি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা এমন পর্যায়ের ছিলো যে শুধুমাত্র সমীহতার কারণে আমি এটা এড়াতে চাইতাম। কামাল সেটা জানতো। সে এটাও জানতো যে আমি তার পিতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ভিন্ন কখনোই অন্য কোনোভাবে সম্বোধন করিনি। বন্ধুর পিতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে আমি কোনো সাধারণ সম্পর্কের মধ্যে কখনোই বাঁধতে পারিনি।
কিন্তু কামাল সেদিন জেদ ধরেছিলো যে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবেই। কামাল জেদ ধরলে তার থেকে ছাড়া পাওয়া কঠিন। সুতরাং তার সাদা ডাটসান গাড়িতে উঠে বসতেই হলো। ‘আমার ঘরেই খাবার আনিয়ে নেবো’, গাড়ি চালাতে চালাতে আশ্বস্ত করতে চাইলো সে আমাকে। আমি মুখ গোঁজ করে থাকলাম।’ তাছাড়া কামাল বলে চলে, ‘এ সময়ে আব্বা বাসায় থাকলেও বিশ্রাম নেন। তুই সামনাসামনি পড়বি না। ভয় নেই তোর’, আমাকে স্বাচ্ছন্দ্য করার চেষ্টা তার। কী করে বন্ধুটিকে বোঝাই যে, এর সঙ্গে ভয়ের কোনো সম্পর্ক নেই, এটা অন্য ব্যাপার।
৩২ নম্বরে কামালের ঘরে পৌঁছানোর পরে বোঝা গেলো ‘তার ঘরে খাবার আনা’র কোনো সম্ভাবনা নেই। তার সে আশ্বাস সুদূরপরাহত। খাবার ঘরেই যেতে হবে। আমার মন বলছিলো বিভ্রাট একটা ঘটবেই। হলোও তাই। খাবার ঘরে যাওয়ার জন্য দোতলার চাতালের মতো জায়গায় পা দিতেই বুঝলাম, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ওই বারান্দায় বেতের চেয়ারে উপবিষ্ট বঙ্গবন্ধু তার চিরায়ত ভঙ্গিতে। তার হাতে জ্বলন্ত পাইপ। সামনের দু’টো চেয়ারে বসে আছেন বরিশালের আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও প্রফেসর মুশাররফ হোসেন। সেরনিয়াবাত তখন খুব সম্ভবত পানিসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী এবং স্যার সদ্য পরিকল্পনা কমিশন ছেড়েছেন। দু’জনের কাছেই আমি পরিচিতÑসেরনিয়াবাতের কাছে বাবার কারণে ও প্রফেসার হোসেনের কাছে তার ছাত্র বলে।
সেরনিয়াবাত আমাকে দেখেই বললেন, ‘আরে, তুমি এখানে?’ তারপর আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই বঙ্গবন্ধুর দিকে ফিরে বললেন, আমাদের প্রফেসার সিরাজুল হকের ছেলে’। বাবার নামটি শুনে বঙ্গবন্ধু আধা মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করলেন। তারপর চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার আব্বার সিভিকস আর ইকোনমিক্সের ওপরে দুইটা পাঠ্যবই আছে না?’ আমি হতবাক! আমার মুখে কোনো কথা ফুটলো না। আমার অবস্থা দেখে স্যার বলে উঠলেন, ‘আমার ছাত্র ও খুব ভালো ছেলে’ এবার কামালের পালা। ‘ইকনোমিক্সে আমাদের ফার্স্টবয়’, বন্ধুগর্ভে কামালের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি খেলে যায়। তারপর পাইপের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে স্মিতমুখে আমাকে বললেন, তোমারে একটা কথা জিগাই ঠিক ঠিক জবাব দেবা কিন্তু। ততক্ষণে আমার হাত,পা, পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। বুঝলাম না কী প্রশ্ন তিনি করবন। ভাবলাম, যদি ঠিক জবাব না দিতে পারি, তাহলে বাবার বন্ধুকে, আমার বন্ধুকে ও আমার শিক্ষককে কি একটা লজ্জায় ফেলে দেবো আমি। আর কী অপদস্থ হবো আমি জাতির পিতার সম্মুখে! নিশ্বাস চেপে কোনক্রমে বললাম, জী।
বঙ্গবন্ধু তাঁর কৌতুকভরা চোখ আমার দিকে তুলে রহস্যভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘বাবা, তুমি তো ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্র। খুব স্বাভাবিক, কামাল তোমার লগে বন্ধুত্ব করতে চাইবে। কিন্তু আমারে কও তো ক্যান তুমি কামালের লগে বন্ধুত্ব করতে চাও ? আমি একমুহূর্ত ভাবলাম। তারপর বঙ্গবন্ধুর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, বন্ধুত্বে অন্য কোন বিষয় বিবেচনা গৌণ, বন্ধুত্বই মূখ্য। এটুকু বলতেই আমার জিভ শুকিয়ে গেল।
আমার জবাব শুনে বঙ্গবন্ধুর মুখ প্রসন্ন হাসিতে ভরে গেলো। স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুখোড় ছাত্র আপনার। তারপর কামাল আর আমাকে সস্নেহ কণ্ঠে বললেন, যা তোরা খা গিয়া। ঘর থেকে বার হতে হতে শুনলাম, তিনি প্রফেসার মুশাররফ হুসেনকে বলছেন, প্রফেসার সাব পোলাটারে দেইখ্যা রাখবেন। তারপর সারাদিন এবং তার পরের দিনগুলো কেমন করে গেল, তা আমার মনে নেই। আমি যেন হাওয়ায় ভাসছিলাম। অপার এক আনন্দে আমার সারা মন ভেসে যাচ্ছিল।
তারপর ৪৫ বছর কেটে গেছে। আজ বঙ্গবন্ধু নেই, আমার বন্ধু শেখ কামাল নেই, নেই বন্ধু খুকীও। নেই তাদের বহু নিকটজনেরা। বঙ্গবন্ধুকে যে দিন কাছ থেকে দেখেছি, তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, তার এক বছরের মধ্যে ঘাতকের হাতে সপরিবারে নিহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সে যে কত বড় কলঙ্ক আমাদের। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সেই হিরন্ময় দিনটির কথা পড়ছে। তাঁকে আমি শুধু একদিনই কাছে থেকে দেখেছি, একদিনই ক্ষণিকের জন্যে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। একদিনই একবারই মাত্র সেটা ঘটেছে। কিন্তু তাতে আমার দুঃখ নেই। সেই একদিনই তো আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি -যার স্মৃতি আমি চিরদিনই হৃদয়ে বহন করবো। ছবি কৃতজ্ঞতা: অবয়বপত্রের বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত। শুধুমাত্র মাঝের ছবিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব মুখ্য চিত্রগ্রাহক প্রয়াত জনাব আজমল হকের তোলা ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্টে, যখন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে সলিমুল্লাহ হল, সূর্য সেন হলকে হারিয়ে আন্তহল বিতর্ক জেতে। সাদুর কাঁধে আমি কামালকে শিল্ডটি দিচ্ছি। এটিই সম্ভবত: কামালের জীবনের শেষ ছবি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়