মোহাম্মদ জমির : বাংলাদেশের জন্য মার্চ মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক বাংলাদেশী এমাসের ৭ তারিখটিকে সম্মানের সাথে স্মরণ করেন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন এবং আমাদের সবাইকে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। একইভাবে ১৭ মার্চেও আমরা স্মৃতিকাতর হই এবং দিনটাকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করে থাকি।
বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অবদানের কথা আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে থাকি বিশেষ এই দিনে। ১৯২০ সালের এই দিনে জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধু ছিলেন বীরত্বপূর্ণ সহিষ্ণুতা, সাহস, ধৈর্য্য এবং সততায় পূর্ণ এবং নির্যাতিত মানুষের অধিকার রক্ষায় আজীবন সংগ্রামী। এসব গুণাবলীর কারণেই আমরা তাকে চিনি হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার মামলা ও বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং অন্তত দু’বার মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু কোনসময় তিনি বিচলিত হননি। ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতিতেও তার মুখে থাকতো বিজয়ীর হাসি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন নীতি, আদর্শ ও ভরসার প্রতীক। তার নেতৃত্বেই আমরা শিখেছি কিভাবে সম্মিলিতভাবে চিন্তা ও কাজ করতে হয়। তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি সংষ্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রাণ-প্রকৃতির সমন্বয়ে একত্রে কিভাবে বাস করতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর ওপর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স’ বইয়ের প্রথম খণ্ডের মুখবন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখায় উঠে এসেছে কিভাবে পাকিস্তানি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর ওপর নজর রাখতো এবং কি ধরনের অত্যাচার তাঁর ওপর চলেছে। জানুয়ারি, ১৯৭২ থেকে মে, ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত নতুন গঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছি। সেসময়কার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তলাবিহীন ঝুড়িসহ নানান বিতর্কিত মন্তব্যের পরও বাংলাদেশকে “সোনার বাংলা” করে গড়তে বঙ্গবন্ধুর সংকল্পের সাক্ষী ছিলাম আমি। এই দৃঢ়চেতা সংকল্পের ওপর ভর করেই ব্যাপক গণহত্যার শিকার ও বিধস্ত একটি দেশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু সম্মুখীন হয়েছিলেন একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি ও বিধ্বস্ত অবকাঠামোর দেশের। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন মানচিত্র পাবার পর বাংলাদেশের সামনে আরেক চ্যালেঞ্জ হাজির হলো, তা হলো অস্তিত্বের লড়াই। সকলকে একই প্লাটফর্মে এনে উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। আর বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনা ছাড়া এটি সম্ভব হতো না।
বাংলাদেশের সামনে প্রথম যে চ্যালেঞ্জ এসেছিলো তা হলো যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের পুনর্বাসন। ইউএনএইচসিআরের হিসেবে অন্তত এক কোটি লোক ভারতে চলে গিয়েছিলো। যুদ্ধ শেষ হলে তারা স্রোতের মতো দেশে ফিরতে শুরু করলে তাদের জন্য তাৎক্ষণিক রেশন ও বাড়ি ফেরার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হয়। অসুস্থ ও আহতদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সবার জন্য খাদ্য ও বস্ত্রের সংহার করতে সবাই ছিলো ঐকান্তিক। বঙ্গবন্ধু নিজে এগুলো তদারকি করতেন এবং সমস্যা দেখলেই তার সমাধান দিতেন। আমাদের সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ওই কঠিন মুহুর্তগুলোতে আমদেরকে আরো উৎসাহ দিয়েছে। এরকম ভয়াবহ দুরাবস্থার মধ্যেও তিনি ভেঙে পড়েননি, দায়িত্ব এড়িয়ে যান নি।
বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের এই সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে ইউএনআরওডি তাদের ‘বাংলাদেশ: এ সার্ভে অব ড্যামেজেস এন্ড রিপেইরস’ রিপোর্টে লিখেছিলো, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় ওই সময়ে দুর্ভিক্ষ বা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কোনটাই ঘটেনি। সরকারের সাথে একজোট হয়ে জনগণ সম্মিলিতভাবে কাজ করে চলেছে এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। স্বাধীন দেশ হিসেবে সারাবিশ্বের স্বীকৃতি আদায়ে বঙ্গবন্ধুর অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার একাজের মাধ্যমে মৃত্যুকূপ থেকে উঠে জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী এবং ওআইসির মতো সংস্থাগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে আবির্ভূত হয় বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বাংলায় ভাষণ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির পথ দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এসব অবদান শ্রদ্ধায় স্মরণ করে সবাই। আমরা সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই গভীর সংকটে পথ দেখাতে আমাদের মাঝে বঙ্গবন্ধুকে পাঠানোর জন্য।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত। পররাষ্ট্র নীতি, তথ্য অধিকার ও সুশাষন বিষয়ক বিশ্লেষক
আপনার মতামত লিখুন :