শিরোনাম
◈ বিশৃঙ্খলার পথ এড়াতে শিশুদের মধ্যে খেলাধুলার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে: প্রধানমন্ত্রী ◈ তাপপ্রবাহের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা ◈ সোনার দাম কমেছে ভরিতে ৮৪০ টাকা ◈ ঈদযাত্রায় ৪১৯ দুর্ঘটনায় নিহত ৪৩৮: যাত্রী কল্যাণ সমিতি ◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও) ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু

প্রকাশিত : ০৭ মার্চ, ২০১৯, ০৩:৫৭ রাত
আপডেট : ০৭ মার্চ, ২০১৯, ০৩:৫৭ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য

ওয়ালিউর রহমান : বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই করেছিলেন ৭ মার্চ রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে। সবাই বঙ্গবন্ধুর নিরদেশনার অপেক্ষায়। সেই দিন, বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে জেগে ওঠে পুরো জাতি। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিলো স্বাধীনতা সংরামের, যেদিন তিনি প্রদান করেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। তাতে ছিলো নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা। সেদিন ভাষণ দেবার জন্য মঞ্চে উঠলেন তিনি, সামনে দেখলেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উত্তাল জনতা; নিজেকে প্রস্তুত করলেন এক মহাকাব্য রচনার জন্যে। তিনি জোরালো কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেদিনের অগ্নিঝরা ভাষণে তিনি নির্দেশ দিলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। পাকিস্তানি শাষকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। তিনি বলেছিলেন- ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, যার যা আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ। এটি ছিলো একটি এপিক ভাষণ, এ ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করলেন তিনি। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। তাই বাংলার দামাল ছেলেরা ৯ মাস যুদ্ধ করার মনোবল পেয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর এ তেজদীপ্ত মুক্তির বাণী শোনার জন্য ওইদিন সকাল থেকে দেখের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দলে দলে হেঁটে, বাসে-ট্রাকে-লঞ্চে-ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে নারী-পুরুষের ¯্রােতে সয়লাব হয়ে যায় তখনকার ঘোড়দৌড়ের এই বিশাল ময়দান।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত প্রতীকী স্টাইলে ভাষণটি দিয়েছেন। একদিকে মুক্তিকামী মানুষ দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছেন। ৭ মার্চ সকালে বত্রিশ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড, একান্ত বৈঠকে বললেন, ‘পূর্ব বাংলায় স্বাঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করবে না’। উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব-টা সরাসরি হলো না। হলে, রেসকোর্স হয়ে যেতো লাশের স্তুপ। আমি শুনতে পেয়েছিলাম যে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে কামান তাক করে রাখা হয়েছিলো রেসকোর্স এর দিকে। ওদের আর্টিলারি আর ক্যাভিলারি ছিলো রণসজ্জায়। ২ থেকে ৪ স্কোয়াডন যুদ্ধ বিমান ঢাকার আকাশকে ল-ভ- করে দিতো। অন্যদিকে বহির্বিশ্বেও বংবন্ধুর কুৎসা রটাতে পারতো পাকিস্তানি প্রশাসন- বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দিয়েছেন। তখন সোহরাওয়ারদি উদ্দ্যানে, যা রেসকোর্স নামে প্রসিদ্ধ ছিলো, বোম্বার্ডমেন্ট করে বঙ্গবন্ধুসহ লাখ লাখ বাঙ্গালিকে মারতেও তারা পিছপা হতো না।
আমার মতে, বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের কূটনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেছেন একজন কূটনীতিবিদের মতো। তিনি বলেছেন, বিগত ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ এর নির্বাচন, ‘৫৮ এর সামরিক শাসন , ’৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালি বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন, অন্যদিকে যুদ্ধকৌশলও বলে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, যদি যুদ্ধ হয় তবে বাঙালিরা যেন বর্ষাকালকে বেছে নেয় যুদ্ধের জন্য। কিন্তু পাকিস্তানিরা এ বক্তৃতার সারমর্ম বুঝতে পারেনি। বরং তৎকালীন চধশরংঃধহ ঈযরবভ গধৎংযধষ খধি অফসরহংঃৎধঃড়ৎ বলেছিলেন, ‘ঞযরং রং ঃযব নবংঃ ংঢ়ববপয ঁহফবৎ ঃযব পরৎপঁসংঃধহপবং’ আমার স্বল্প জ্ঞানে আমি এ বক্তৃতাকে তুলনা করি রোমান স¤্রাট সিসেসোর বক্তৃতার সঙ্গে। এ বক্তৃতার তুলনা করা হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পিটস, মার্টিন লুথার কিং এর ভাষণের সঙ্গে। আর তুলনা করা চলে আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত গ্যাটিসবার্গ এড্রেসের সঙ্গে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পরে যখন জেনারেল লি আত্মসমর্পন করেছেন এবং ইউনিয়ন আর্মির প্রধান জেনারেল গ্রান্ট বিজয়ী ও বিজিত উভয় বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে তার চার মাস পর আব্রাহাম লিঙ্কন গ্যাটিসবার্গে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে একটি সামাজিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য সমস্ত মার্কিন জনসাধারণের কাছে একটি মানবিক আবেদন রেখেছিলেন এবং তিনি যখন এ ভাষণটি দিয়েছিলেন তখন গ্যাটিসবার্গ ও তার আসেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো না কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের রেসকোর্সে ভাষণ দেয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো । তিনি বলতে গেলে শত্রুর ঘাঁটির মাঝে বসে জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার ঘোষণা দিলেন। কারণ রেসকোর্স ময়দান থেকে ক্যান্টনমেন্ট মাত্র পাথর ছোঁড়ার দূরত্বে ছিলো, বেখাপ্পা কিছু বললেই তার সাথে সাথে লাখ বাঙালিকে পাকিস্তানিরা নিঃশেষ করে দিতে পারে। তিনি নিপুন কৌশলের সহিত শত্রুর বিরুদ্ধে জনগণকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন, আর বাঙালিদের তা বুঝে নিতে ভুল হয়নি। কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং যেমন বর্ণবাদ বৈষম্যহীন একটি জাতির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য জাতিকে জাগ্রত হতে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ও তার ৭ মার্চ ভাষণে ঠিক তেমনি বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতিকে জাগ্রত হতে বলেছিলেন সংগ্রাম করতে বলেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন তার ভাষণের দ্বারা জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ও ৭ মার্চের সেই অলিখিত স্বতস্ফুর্ত ভাষণের দ্বারা জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও মার্টিন লুথার কিং এর স্বপ্ন একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র দিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের সমতা। শ্বেতাঙ্গদের সাথে এক স্কুলে পরার সাংবাদিক অধিকার তারা পেলো।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যদি আমরা সাহিত্য সমালোচনার দৃষ্টিতে বিচার করি তাহলে সহজেই এর মহাকাব্যিক আঙ্গিক উপলব্ধি করতে পারি। মহা কবিরা সাধারণত কোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তার লেখার উপজীব্য বা বিষয়বস্তু হিসেবে নির্ধারণ করেন যার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট জাতির ইতিহাস যা পাঠ করে মানুষ আন্দোলিত হয়, অনুপ্রাণিত হয় এবং কোনো মহৎ কর্মে দীক্ষিত হয়। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু কয়েক মিনিটের একটি অলিখিত ভাষণ সেইটির প্রতিরূপ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি মহাকাব্যিক আবেদন মহাকালই বিচার করবে। লাখো জনতার সামনে একটি অনুপম কবিতার মত, স্ফুলিঙ্গের মতো সাগরের উত্তাল জলরাশির মত সত্য সুন্দর শব্দগুলোকে উচ্চারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু।
এ ভাষণের ব্যঞ্জনা তাৎপর্য ও গুরুত্ব সেদিন যারা কাছে বসে শুনেছেন তারাই বুঝতে পারবেন। সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক করতে এই ভাষণের কোনো বিকল্প ছিলো না। তিনি যথার্থই সরবকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত ঘোষণা, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’- সত্য হয়েছিলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মধ্যদিয়ে। এ ভাষণের সুর অনুসরণ করেই এক নতুন রেনেসাঁর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলো।
লেখক : কূটনৈতিক, লেখক, গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ।

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়