বিভুরঞ্জন সরকার : আমরা বাঙালিরা সম্ভবত উত্তেজনা পছন্দ করি। উত্তেজনাকর ঘটনা না ঘটলে আমাদের ভালো লাগে না । কীভাবে কীভাবে যেন একের পর এক উত্তেজনার ঘটনা আমাদের সামনে এসেও যায়। কোনো কারণে যদি উত্তেজনা না থাকে তাহলে আমরা ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হইÑ কোনো উত্তেজনা নেই কেনো? যেমন ধরুন আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে একেবারেই উত্তেজনাহীন পরিবেশে। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় আমাদের অনেকেরই মন ভালো নেই। এমন একতরফা পানসে নির্বাচন মেনে নিতে মন সায় দেয় না। নির্বাচন হবে অথচ উত্তেজনা হবে না এমন নির্বাচন হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো। তবে এই নির্বাচনের আগে না হলেও পরে কিছুটা উত্তেজনা হবে ঠিকই। নির্বাচনের ফলাফল কি হবে সেটা আগেই বলা যায়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের চারজন প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন ঠিকই কিন্তু জয়ের মালা আতিকের গলায়। এটা আগেভাগে বলার জন্য জ্যোতিষী বা গনক হওয়ার দরকার নেই। নৌকা নিয়ে বিপুল ভোটে আতিকুল ইসলাম জয়যুক্ত হবেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি যাই হোক না কেনো ভোটের পরিমাণ তাতে কমবে না। দেশে এখন নৌকার জোয়ার এবং জয়জয়কার। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপনির্বাচন এই জোয়ারের বাইরে নয়। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বলা হবে যে, এটা কোনো নির্বাচনই হয় নাই। এই ফলাফল আমরা মানি না । বড় উত্তেজনা না হলেও ছোটখাটো উত্তেজনা দুইচারদিন চলবে, আমাদের কিছুটা আশা পূরণ হবে। তারপর আবার ‘যথা পূর্বং তথা পরং’।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে যথেষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবিত বিজয় এবং বিএনপির লজ্জাজনক পরাজয়ের পরও কিছুটা উত্তেজনা ছিলো। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই চারিদিক শান্ত, সবকিছু স্বাভাবিক। এই অবস্থাটা আমাদের ভালো লাগছিলো না। তাহলে কি আমাদের জীবন নিরুত্তেজক কাটবে? না। উত্তেজনা এসে গেলো ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে প্রাণ গেলো বেশ কয়েকজন নারী, পুরুষ ও শিশুর। জীবনের দাম আমাদের দেশে সবচেয়ে কম। তাই জীবন নিয়ে হেলাফেলা চলে সবচেয়ে বেশি। নয় বছর আগে প্রায় একই রকম প্রাণঘাতি অগ্নিকা-ে জীবন হারান ১২৪ জন মানুষ। আমরা কোনো শিক্ষা নিলাম না। অপেক্ষায় থাকলাম আরও একটি দুর্ঘটনার। সে দুর্ঘটনাটিও ২০ ফেব্রুয়ারি ঘটলো। আমরা আবার উত্তেজিত হলাম। এই উত্তেজনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক উত্তেজনা, ঢাকা থেকে দুবাইগামী একটি বিমান ‘খেলনা পিস্তল’-এর ভয় দেখিয়ে হাইজ্যাকের ব্যর্থ চেষ্টা। এই উত্তেজনাও খুব স্থায়ী হলো না। ছিনতাইকারী কমা-ো অপারেশনে নিহত হলো। কেনো পলাশ নামের যুবকটি বিমান হাইজ্যাকের নাটকীয়তা করতে গিয়েছিলো সেটা আমাদের জানা হলো না। তবে এই সুযোগে জানা গেলো পলাশ বিয়ে করেছিলেন আমাদের চলচ্চিত্র জগতের এক তারকা সিমলাকে।
সিমলাকে নিয়ে রস পাকানো শেষ না হতেই শুধু জাতীয় নয়, এক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনায় আমরা কাঁপছি। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগে লাগে ভাব। হুমকি-ধামকি চলছে। আকাশে উড়ছে যুদ্ধবিমান। ভূপাতিতও হচ্ছে দু’চারটি। একে অপরের বিরুদ্ধে পরস্পরবিরোধী সাফল্যও দাবি করছে। অনেকেই ডুগডুগি বাজাতে শুরু করেছেন, লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ। কিন্তু লাগবে কি যুদ্ধ। দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পরলে সেটা শুধু দুই দেশের জনগণের জন্য দুঃখ- দুর্দশার কারণ হবে না। সেটা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকেও প্রভাবিত করবে। বিশ^মোড়লেরা বাহ্যত উত্তেজনা প্রশমনের কথা বললেও ‘অস্ত্রবাণিজ্যের’ সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থেকে যুদ্ধের উত্তেজনায় বাতাস দেবে না, সে নিশ্চয়তা কি দেয়া যায়? এই উত্তেজনা কতোদিন স্থায়ী হবে বলা মুশকিল। তবে নানা রকম উত্তেজনায় ঢাকাই চলচ্চিত্রের সংলাপ ধার করে বলতে হয়, ‘মাথাই নষ্ট’। নষ্ট মাথা নিয়ে লেখার কষ্ট না করে আরেকটি নতুন উত্তেজনার জন্য অপেক্ষা করাই ভালো। মহান সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় রাখবেন না।
লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়
আপনার মতামত লিখুন :