শিরোনাম
◈ জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন ◈ ইরানের ইস্পাহান ও তাব্রিজে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, ৩টি ভূপাতিত (ভিডিও) ◈ জাতিসংঘে সদস্যপদ প্রস্তাবে মার্কিন ভেটোর নিন্দা ফিলিস্তিনের, লজ্জাজনক বলল তুরস্ক ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক

প্রকাশিত : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৭ দুপুর
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৭ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সুন্দরবনে বিষ : সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নয় কী?

মহসিন উল হাকিম : সুন্দরবনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনটি? কেউ বলবেন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেউ বলবেন, বাঘ-হরিণ শিকার, গাছ চুরি ও পাচার। কেউ বলবেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যন্ত্রচালিত নৌযান চলাচল বা জাহাজ-কার্গো চলাচল। আবার সুন্দরবনের ভেতরে যারা মাছ-কাঁকড়া ধরেন, সেই জেলে বাওয়ালীরাও সুন্দরবনের যথেষ্ট ক্ষতি করেনÑ এগুলো সবই মানুষের তৈরি বিপদ, সুন্দরবনের জন্য।
অন্যদিকে প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে নদী ও সাগরের ভাঙ্গনেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। নদী-খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। উজানের মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের নোনা পানির চাপ বেড়েছে। সাগরের নোনা পানির কাছে এখন পরাজিত নদীর পানির প্রবাহ। ফলে দিনকে দিন বাড়ছে লবণাক্ততা। আর সে কারণে শুধু সুন্দরবন নয়, পুরো উপকূলের পরিবেশ ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে। তারপরও এতোগুলো বিপদকে পাশ কাটিয়ে টিকে আছে সুন্দরবন। এভাবে বন আর বনের প্রাণবৈচিত্র্য কতোদিন টিকে থাকবে সেই প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আসবেই। পেশাগত কাজে অনেকবার সুন্দরবনে গেছি। উল্লিখিত কারণগুলোর পাশাপাশি আরেকটি ঘটনা আমার কাছে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের কারণ বলে মনে হয়। আমি বিজ্ঞানী নই, জলবায়ু বা প্রাণবৈচিত্র্য বিশারদও নই। সাদা চোখে যা দেখেছি, তাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি এখানে। আমার দৃষ্টিতে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় বিপদের নাম ‘বিষ’ বা বিষ দিয়ে মাছ শিকার’। সারাবছর সুন্দরবনের খালগুলোতে যেভাবে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হয়, তাতে ভেতর থেকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন।
পশ্চিমে সাতক্ষীরার রায়মঙ্গল নদী থেকে পূবদিকের বলেশ্বর... লোকালয়ের কাছাকাছি খালগুলো বছর দশেক আগেই মাছশূন্য হয়ে গেছে। জেলেরা বলেন, জোয়ার ভাটার কারণে দেড় মাসের মধ্যে বিষের প্রতিক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। আবারও বড় খাল-নদী থেকে মাছ ঢুকে পড়ে সেই খালগুলোতে। আবার সেই জেলেরাই বলেন, বিষের কারণে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। মাছ পেতে হলে তাদের যেতে হয় অনেক দূরে।
আমার প্রশ্ন, খালের পানিতে বিষ দিলে কী শুধু মাছ মারা পড়ে? নাকি পানির ভেতরের যতো রকম প্রাণ-অনুপ্রাণ আছে, তার সবই ধ্বংস হয়। পানির ভেতরে যে উদ্ভিদগুলো থাকে, সেগুলোও কী ক্ষতিগ্রস্ত হয় না? এর উত্তর জানতে বা ভাবতে বিজ্ঞানী বা বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কারণ চোখের সামনেই দেখেছি বিষ দিয়ে মাছ শিকারের দৃশ্য। সেখানে বিষক্রিয়ায় মাছ, কাঁকড়া, সাপ, শামুক, ঝিনুক, পোকা-মাকড়সহ সবকিছুই মরতে দেখেছি। এখন পুরো বনের ভেতরের খালগুলোতে যদি এভাবে মাছধরা চলতে থাকে, তবে মাছ বাঁচবে কী করে? কী করে বাঁচবে বাকি জলজ প্রাণীগুলো? আবার সেই ভয়ঙ্কর কর্মকা- বনের অভয়াশ্রমগুলোতেই বেশি চলে।
অভয়াশ্রমে মা মাছ আসবে, ডিম দেবে, বাচ্চা ফুটবে, সেই বাচ্চাগুলো বড় হবে, তারপর বের হয়ে বড় খাল-নদী আর সাগরে যাবে। সেই মাছগুলো আবার মা মাছ হয়ে ফিরে আসবে অভয়াশ্রমের খালে খালে। এমনটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু বিষ দিয়ে মা মাছগুলো যেমন মরছে, তেমনি মাছের পোনাগুলোও মারা পড়ছে বছরজুড়ে।
এদিকে সুন্দরবনের মাছ-কাঁকড়া ও পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে কুমির, বিভিন্ন রকমের সাপ, ভোঁদড়, গুইসাপ, ডলফিন, নানা প্রজাতির বক-পাখি, বানর এমনকি আমাদের বেঙ্গল টাইগার। প্রথমত বিষক্রিয়াযুক্ত পানি থেকেই তারা শিকার ধরছে। বিষযুক্ত মাছ খাচ্ছে, সেই বিষাক্ত পানিও পান করছে তারা। ক্ষতিটা হচ্ছে ভেতরে থেকে। এর প্রতিক্রিয়া চোখে না দেখে বোঝা যায় না, ধারণাও করা যায় না। বিষক্রিয়ার দৃশ্য যারা নিজের চোখে দেখেছে, তারা কিছুটা বুঝতে পারবেন। আর বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝতে পারবেন ক্ষতির মাত্রা। তবে গত দশ বছরে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, লোকালয় থেকে ত্রিশ থেকে চল্লিশ কিলোমিটার পর্যন্ত বনের খাল-নদীতে বিষ দিয়ে মাছ শিকার চলে। এসব এলাকায় মাছ আগের মতো পাওয়া যায় না। তাই মাছ ধরতে এই অপকর্মের পরিধি বাড়ছে। সুন্দরবনের একটু নিচের দিকে, এমনকি সাগরের কাছাকাছি খালগুলোতেও এখন বিষ দিয়ে মাছধরা শুরু হয়েছে।
দশ বছর আগেও সুন্দরবনের খালগুলোতে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ঢুকলে পাখি আর বনমোরগের ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যেতো। চোখে পড়তো নানা রঙের হাজার হাজার পাখি। এখন সেই খালগুলোতে গেলে কিছু মাছরাঙা আর বক দেখা যায়। গাছে গাছে বিভিন্ন জাতের কিছু পাখিও চোখে পড়ে। আগে সুন্দরবনের ভেতরে অনেক মদনটাক পাখি দেখতাম। সেই পাখিও এখন অল্পকিছু চোখে পড়ে। সন্ধ্যায় চরের কোল ঘেঁষে দ্রুত উড়ে যাওয়া বাটাং পাখিও দেখি না আগের মতো। অন্য পাখির সংখ্যাও কমেছে, আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে।
সুন্দরবনের খালে খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার অপকর্ম বেশি চলে বর্ষাকালে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিষ পড়ে সুন্দরবনের খালগুলোতে। বিষ বলতে চিংড়ি মাছের জন্য ব্যবহার করা হয় তরল কীটনাশক। আর সাদা মাছের জন্য ব্যবহার করা হয় পাউডার জাতীয় বিষ। মূলত মরা গোনে চলে এই অপকর্ম। বিষ দিয়ে মারা মাছ দেদারসে বিক্রি হয় বাজারে বাজারে।
অবশ্য সুন্দরবনে হরিণের সংখ্য বেড়েছে বলে মনে হয়। শুকর-বানরের সংখ্যাও বেড়েছে সম্ভবত। হরিণ শিকার কমে-বাড়ে। বাঘ শিকারের কথা শুনি না অনেকদিন। বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বা বাড়ছে বলেই শুনছি। সেটা খুব ভালো খবর। বন রক্ষায় বন বিভাগের তৎপরতা বেড়েছে। তবে এখনও গাছ চুরির ঘটনা ঘটছে। বনের ভেতরের নিষিদ্ধ অঞ্চলে মাছ ধরছে জেলেরা। অবৈধভাবে বনের ভেতরে কোথাও কোথাও চলছে মাছ শুঁটকি করার কাজ।
বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধে বন বিভাগের চেষ্টা আছে। কিন্তু নানা কারণে সেই চেষ্টা এখনও তেমন কাজে আসছে না। এ বিষয়ে স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতাও আসেনি। বরং একশ্রেণির মাছ ব্যবসায়ী এই অপকর্মে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
সুন্দরবন একটি বিশাল জায়গা। বৈচিত্র্যে ভরপুর এই শ্বাসমূলীয় বন নিয়ে কথা বলা বা লেখার যোগ্যতা আমার নেই। তবে এটুকু বুঝেছি, সুন্দরবন নিয়ে ধারণা বা পারসেপশনের ওপর ভিত্তি করে কিছু বলার সুযোগ নেই। তারপরও বলি, বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করতে না পারলে এই একটি কারণেই সুন্দরবনের মৃত্যু হবে। আসুন সবাই মিলে সুন্দরবনকে ভালোবাসি। শুধু ফেসবুকে নয়, সত্যিকারের ভালোবাসি। কারণ সুন্দরবন শুধু দিয়েই যায়, নেয় না কিছুই। ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়