ভজন সরকার : বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস আগামী এক দশকের মধ্যেই পৃথিবীর নিকটতম বাসযোগ্য প্রতিবেশী মঙ্গলে মানুষ পা ফেলবে। আর সে লক্ষ্যেই চলছে লোহিত এ গ্রহে নাসার অভিযান ও আয়োজন। ‘মঙ্গলগ্রহ মিশন ২০২০’ নিয়ে ধুন্ধুমার কা- চলছে নাসার ‘জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি’তে।
নাসা ২০২০ সালে যে যান্ত্রিক শকট পাঠাবে তার কোনো আনুষ্ঠানিক নাম এখনো ঠিক হয়নি। কিন্তু উৎক্ষেপণ ও অবতরণ স্থানসহ বিজ্ঞানীরা কী কী পরীক্ষা করবে সবই চূড়ান্ত এখন। অপেক্ষা ও প্রচেষ্টা চলছে যান্ত্রিক শকট বা গাড়িকে আরও নির্ভর ও কার্যকরী করার।
বিজ্ঞানীদের মঙ্গলগ্রহ অভিযান এবং পৃথিবী সাদৃশ্য এ গ্রহটির প্রতি আগ্রহ বহুদিনের। মঙ্গলের পৃষ্ঠে যান্ত্রিক শকট বা রোভার পাঠানোর প্রচেষ্টা ১৯৭১ সাল থেকেই। যদিও সফলতা এসেছে আরও পরে ১৯৯৭ সালে। দু’ ধরনের যন্ত্রযান মঙ্গলে অবতরণ করেছে এ পর্যন্ত, প্রথমটি যান্ত্রিক শকট বা রোভার- যা মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠে চলাচল করতে পারে এবং দ্বিতীয়টি, স্থির যন্ত্র বা ল্যান্ডার-যা মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠে এক জায়গায় স্থির থাকে। ফলে রোভারের কার্যকারিতা ল্যান্ডারসের চেয়ে বেশি।
মঙ্গলগ্রহে এ পর্যন্ত চারটি রোভার অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
১. প্রথমটি ‘সোজারনার রোভার’ ১৯৯৭ সালে অবতরণ করে মাত্র মাস চারেক পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রেখে চিরতরে হারিয়ে গেছে। ২. দ্বিতীয়টি ‘স্পিরিট রোভার’ ২০০৪ সালের ৪ জানুয়ারি অবতরণ করে প্রায় ৭.৭ কিলোমিটার চলেছিলো মঙ্গল ভূ-পৃষ্ঠে। তারপর পৃথিবীর সাথে শেষ যোগাযোগ হয়েছে ২০১০ সালের ২২ মার্চ। এর পরে এক ধূলিঝড়ে বালুর গভীরে হারিয়ে গেছে। ৩. তৃতীয়টি, ‘অপরচুনিটি রোভার’ ২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি অবতরণ করে পনেরো বছরে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার চলে প্রচ- ধূলিঝড়ে ঢাকা পড়ে গেছে। ‘অপরচুনিটি রোভার’ থেকে শেষ যোগাযোগ হয়েছে ২০১৮ সালের ১০ জুন। নাসার বিজ্ঞানীদের শত চেষ্টাতেও দীর্ঘ সেবা দেয়া এ যান্ত্রিক শকটটিকে আর পূর্ণজীবন দেয়া যায়নি। নাসার বিজ্ঞানীরা ‘অপরচুনিটি রোভার’কে চিরবিদায় জানিয়েছেন ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। ৪. চতুর্থটি ‘কিউরোসিটি রোভার’ ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর অবতরণ করে এখন পর্যন্ত (১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) পৃথিবীতে মঙ্গলগ্রহ থেকে যোগাযোগ করে যাচ্ছে। পাঠাচ্ছে দারুণ সব ছবি- যা বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যতে সহায়ক হবে।
তাছাড়া নাসার পাঠানো ‘ইনসাইট ল্যান্ডার’ যা মাত্র মাস তিনেক আগে ২৬ নভেম্বর ২০১৮ সালে অবতরণ করলো সেখান থেকেও পাঠানো শুরু হচ্ছে নানা তথ্য-উপাত্ত। নাসা ছাড়াও রাশিয়াসহ আরও কয়েকটি সংস্থার ল্যান্ডার এবং স্যাটেলাইট মঙ্গলের বায়ুম-লে অবস্থান করে নিয়মিত তথ্য পাঠাচ্ছে পৃথিবীতে।
সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে নাসার বিজ্ঞানীরা দারুণ আশাবাদী ‘মঙ্গলগ্রহ মিশন ২০২০’ নিয়ে। মঙ্গলগ্রহের ভূ-পৃষ্ঠের গুণাগুণ বিবেচনা করে প্রাথমিকভাবে কতোগুলো স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিলো- যেখানে এ যান্ত্রিক শকট বা রোভারটি অবতরণ করবে। সেখানে থেকে প্রাণের সম্ভাব্যতা বিবেচনায় অবতরণ স্থানটি মোটামুটি চূড়ান্ত করা হয়েছে ( ছবি সংযুক্ত)। ‘জেজিরো ক্র্যাটার’ নামের এ স্থানটির ছবি পরীক্ষা করে দেখা গেছে শুকিয়ে যাওয়া জলের ধারার চিহ্ন- যা আনুমানিক ৩.৫ বিলিয়ন থেকে ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগের।
‘মঙ্গলগ্রহ মিশন ২০২০’ এ বিজ্ঞানীরা প্রধানত মঙ্গলগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব, ভ-ূপৃষ্ঠ ও ভূ-অভ্যন্তরের মাটির গুণাগুণ, আবহাওয়া এবং ভবিষ্যতে প্রাণধারণ উপযোগী অক্সিজেন সৃষ্টির সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণা করবেন। ফলে এ যান্ত্রিক শকটটিতে থাকবে মোটামুটি একটি উন্নতমানের বিজ্ঞান গবেষণাগার। মঙ্গলগ্রহে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে নিজে নিজেই গবেষণা করে গবেষণালব্ধ ফলাফল পৃথিবীতে পাঠাবে ‘মঙ্গলগ্রহ মিশন ২০২০’।
২০২০ এর জুলাই কিংবা আগস্ট মাসেই পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে ‘মঙ্গলগ্রহ মিশন ২০২০’। এ সময়কে বেছে নেয়া হয়েছে কারণ পৃথিবী ও মঙ্গল এ দু’টো প্রতিবেশী গ্রহ এ সময়ে মহাকাশযানের পক্ষে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। ফলে সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিলে অবতরণ করবে ‘মঙ্গলগ্রহ মিশন ২০২০’।
২০২১ সালেও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ( ইএস এ) রোবটবাহী আরেকটি রোবটবাহী মহাকাশযান, যার নাম দেয়া হয়েছে রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন, সেটা পাঠাবে মঙ্গলগ্রহে।
ইতোমধ্যে স্পেসএক্স-এর প্রতিষ্ঠাতা ইলোন মাস্ক ২০২৪ সালে মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানোর এক ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন। পৃথিবীর অনেক বিত্তশালী মানুষ মঙ্গলগ্রহে যাবার বিলিয়ন ডলার মূল্যের ওয়ানওয়ে টিকিটও কনফার্ম করে ফেলেছেন।
সব কিছু বিবেচনায় পৃথিবীর নিকট প্রতিবেশী মঙ্গলগ্রহে মানুষের সম্ভাব্য দ্বিতীয় বাসস্থান স্থাপনের কাজ বেশ এগিয়েই যাবে আগামী কয়েক বছরে। মহাকাশ বিজ্ঞান তো বটেই, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতেও দারুণ সব ঘটনা ঘটবে আগামীতে।
লেখক : বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী, কবি ও কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :