ডেস্ক রিপোর্ট : দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হচ্ছে আজ। তবে এখনো পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে স্থাপনসহ সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে আন্দোলনের মাঠে রয়েছে সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো। দাবি আদায় না হলে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে তারা। ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে স্থাপনের দাবিতে গতকালও ভিসির কার্যালয় ঘেরাও করেছে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগাতিশীল ছাত্র জোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য। গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে নির্বাচন পেছানোসহ সাত দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম না কেনার কথা জানিয়েছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। দাবি আদায় না হলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছেন, নির্বাচন পেছানো এবং ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে নেয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ‘স্বতন্ত্র জোট’ নামে একটি জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের জনমত গড়ে তুলতে ক্যাম্পাসে লিফলেট বিতরণ করেছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্লাটফরম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।’ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারকে আধুনিক, যুগোপযোগী, মানসম্মত, ডিজিটাল করে ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণে সক্ষম কমপ্লেক্স করার দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ সদস্যের নির্বাচনী প্যানেল ঘোষণা করেছে জাসদ ছাত্রলীগ (আম্বিয়া)।
গতকাল দুপুরে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মু. সামাদ বলেন, আগামীকাল (আজ) থেকে হলগুলোতে প্রাধ্যক্ষরা মনোনয়ন ফরম বিতরণ করবেন। আগামী ২৫শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম বিতরণ চলবে। আমরা আশা করছি উৎসবমুখর পরিবেশ শিক্ষার্থীরা মনোনয়ন ফরম কিনবে। ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন পেছানো কিংবা হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ নেই। এখানে আমরা শিক্ষকরা নির্বাচন করবো। এটা নৈতিকতার বিষয়। আমরা চাই না নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। অধ্যাপক সামাদ বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে করতে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবো। আমরা চাই সামান্য ঘাটতি থাকলেও যেন নির্বাচনাটা শুরু হয়। কারণ এটি দীর্ঘদিন যাবৎ অচল হয়ে আছে। কোথায়ও যদি সংশোধনীর প্রয়োজন হয় সেটা আমরা বসে ঠিক করবো। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ভোট প্রদানের সময় কম বলে ছাত্র সংগঠনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রো-ভিসি বলেন, দুপুর ২টার মধ্যে যারা হলের মূল গেইটে প্রবেশ করবে তারা ভোট দিতে পারবে।
ভিসির কার্যালয় ঘেরাও বামপন্থি ছাত্র জোটের
হলের বাইরে এনে একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবিসহ ছয় দফা দাবিতে ভিসির কার্যালয় ঘেরাও করেছে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্য। গতকাল দুপুর পৌনে ১টা থেকে পৌনে ২টা পর্যন্ত এ ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে তারা। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মধুর ক্যান্টিন থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে তারা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ভিসির কার্যালয় ঘেরাও করে।
এর আগে দাবি আদায়ে গতকার পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়েছিল বামজোট। ঘেরাও কর্মসূচিতে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ইকবাল কবীর বলেন, অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে গিয়ে কেবল ছাত্রলীগের দাবি অনুযায়ী হলে ভোটকেন্দ্র রেখেছে প্রশাসন। যেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বসেছিল, ছাত্রলীগ কি বলে তা মেনে নেয়ার জন্য। দাবি না মানলে পরবর্তীতে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। জোটের অন্যতম শরিক সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, আমরা ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাই। একই সঙ্গে হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানাই। আমাদের দাবি আদায় না হলে আমরা ভোটে যাওয়ার বিষয়টিও পুনর্বিবেচনায় নিবো। দুই জোটের ছয়টি দাবি হলো- ‘ক্যাম্পাস ও হলগুলকে সন্ত্রাস-দখলদারিত্বমুক্ত করে সংগঠনগুলোর সহাবস্থান ও শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত’ ‘গেস্টরুম-গণরুমে নির্যাতন বন্ধ ও আগের সকল নির্যাতনের বিচার’, ‘প্রয়োজন ও মেধার ভিত্তিতে প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে প্রথম বর্ষ থেকেই বৈধ সিটের ব্যবস্থা করা’, ‘ডাকসু ও হল সংসদ ফি প্রদানকারী শিক্ষার্থীদের ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার অধিকার নিশ্চিত’, ‘হলে অবস্থানরত ও সংযুক্ত সকল শিক্ষার্থীর ভোটাধিকার সুরক্ষায় ভোটকেন্দ্র একাডেমিক ভবনসমূহে স্থাপন’, ‘শ্রেণিকক্ষে প্রচারণা, নির্বাচনী সমাবেশে জাতীয় নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে বাধাসহ আচরণবিধি অগণতান্ত্রিক বিধানসমূহ বাতিল করা।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মনোনয়ন কিনছে না ছাত্রদল
এদিকে সাত দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। দাবি আদায় না হলে ডাকসু নির্বাচনে না গিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে দীর্ঘদিন যাবৎ ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা ছাত্র সংগঠনটি। সংগঠনটি জানিয়েছে প্রথম দিনেই মনোনয়ন ফরম না নিয়ে দাবি বাস্তবায়নের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। গতকাল মধুর ক্যান্টিনের সামনে সাংবাদিকদের এমনটাই জানিয়েছে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে আমরা ইতিবাচক থাকতে চাই। বারবার টেকসই সহাবস্থানের দাবি জানিয়ে আসছি। সহাবস্থান বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হোক এটাই জানিয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা নির্বাচনে থাকতে চাই। যদি প্রশাসন তাদের একগুঁয়েমি আচরণ অব্যাহত রাখে আমরা তার প্রতিবাদ জানাবো। প্রথম দিনই আমরা মনোনয়নপত্র নিবো না। দাবি বাস্তবায়নের শেষ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো। এ সময় তিনি বামপন্থিদের কর্মসূচিকে সমর্থনের কথা জানান।
২৪শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র অধিকার পরিষদের প্যানেল ঘোষণা
আগামী ২৪শে ফেব্রুয়ারি নিজেদের প্যানেল ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্লাটফরম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। গতকাল পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূর এ তথ্য জানিয়েছেন। এ সময় তিনি হল সংসদগুলোতে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল না দিতে পারলেও বেশিরভাগ পদেই প্রার্থী দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানান। এদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের জনমত গড়ে তুলতে ক্যাম্পাসে লিফলেট বিতরণ করেছে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। গতকাল ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে লিফলেট বিতরণ করে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা। নুরুল হক নূর বলেন, ডাকসু নির্বাচন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো, শিক্ষার্থীদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত ও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জনমত গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের মাঝে লিফলেট বিলি করেছি। শিক্ষার্থীদের থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি। আশা করবো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সকল শিক্ষার্থীর বিষয়টি মাথায় রেখে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
ছাত্রলীগের মানববন্ধন
এদিকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারকে আধুনিক, যুগোপযোগী, মানসম্মত, ডিজিটাল ও ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণে সক্ষম কমপ্লেক্স করার দাবিতে মানববন্ধন করেছে ছাত্রলীগ। গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনসহ কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে থাকি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমাদের যে মেধার বিকাশ ঘটবে, সেই মেধার বিকাশের জন্য পড়াশোনার যে পরিবেশ দরকার তা আমরা প্রথম বর্ষ থেকে পাচ্ছি না। আমাদের পড়ার জন্য সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে লাইব্রেরিতে পড়ার জন্য লাইন ধরতে হয়।
তাই প্রশাসনের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, হলের রিডিং রুমের সিট বৃদ্ধি করার আহ্বান করছি। গোলাম রাব্বানী বলেন, ছাত্রদের দাবি আদায়ে যা কিছু প্রয়োজন ছাত্রলীগ তা করবে। শিক্ষার্থীদের অধিকারের প্রশ্নে ছাত্রলীগ কোনো ছাড় দেয়নি, দেবেও না। জন্ম থেকে ছাত্রলীগ ছাত্রদের অধিকার আদায়ে কাজ করে আসছে, সামনেও তা অব্যাহত থাকবে।
জাসদ ছাত্রলীগের একাংশের প্যানেল ঘোষণা
এদিকে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে খসড়া প্যানেল ঘোষণা করেছে জাসদ ছাত্রলীগের (আম্বিয়া) একাংশ। গতকাল দুপুরে মধুর ক্যান্টিনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলন এই প্যানেল ঘোষণা করে সংগঠনটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি শাহজাহান আলী সাজু। খসড়া তালিকায় প্রার্থী করা হয়েছে ২৫ জনকে। তারা হলেন- মাহফুজুর রহমান রাহাত (ভিপি), শাহরিয়ার রহমান বিজয় (জিএস), নাঈম হাসান (এজিএস), শিরিন আক্তার (স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক), তন্ময় কুমার কুণ্ডুু (বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক), ফজলে এলাহী জিসান (কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক), ইয়াসিন আরাফাত রাহী (আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক), আদনান হোসেন অনিক (সাহিত্য সম্পাদক), সাইফুল ইসলাম রোমান (সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক), মাহবুবুর রহমান হাবিব (ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক), এহসানুল হক হিমেল (ছাত্র পরিবহন সম্পাদক), আল আমিন শিকদার (সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক)। এ ছাড়াও সদস্য পদে রয়েছেন-সাদিকুর রহমান সাগর, মশিউর রহমান জারিফ, সংগ্রামী মোহন উচ্ছ্বাস, আশরাফুল আলম ফাহিম, মো. নাবিদ নেওয়াজ, মাশফিক আরেফিন, রিফাত বিন মুত্তাসিম আহমেদ, তৌফিক আহমেদ, শাকিব ওয়ালিদ তৌহিদ, রাহাত আরা রুমি, মেহেদি হাসান, এস এম সামিউল বাশার সিদ্দিকী পার্থ এবং আরাফাত আহমেদ নাইম।