কাকন রেজা : গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে বিষ পানে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিলো। ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’, তিনি শির উঁচু করেই হেমলক পান করেছিলেন। দুই হাজারেরও বেশি বছর ধরে ‘পশ্চিমা’ এই মহান দার্শনিকের তত্ত্ব আর দর্শনকে তাদের সভ্যতার ভীত হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছে। যে পাশ্চাত্য সভ্যতা, দর্শনের কথা বলা হয় তার ভিত্তি প্রস্তর সক্রেটিসই স্থাপন করেছিলেন। যারা জানেন না, তারা স্বভাবতই প্রশ্ন করবেন, তবে সক্রেটিসকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিলো কেন? জবাব একটাই, শাসকদের রুদ্র রোষে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিলো তৎকালীন দৈশিক দেবতাদের প্রতি উপেক্ষা, নতুন দেবতার কথা বলা এবং যুবকদের নৈতিক স্খলনের। আর এই অভিযোগ এনেছিলেন রাজ আনুকূল্যপ্রাপ্ত তিন ব্যক্তি। যাদের একজন কবি, অন্যজন বাগ্মী, অপরজন নেতা। মূলত সক্রেটিস ছিলেন এসব রাজানুকূলদের ঈর্ষার শিকার। চিন্তা, চেতনা এবং প্রকাশের ভাষা ও দৃঢ়তার প্রতি ঈর্ষা পরিণত হয়েছিলো অ্যাসাসিনের চিন্তায়। পরাজিত আর ব্যর্থদের চিন্তায় থাকে অ্যাসাসিনেশন।
সর্বকালের সেরা ক’জন বিজ্ঞানীর মধ্যে গ্যালিলিও। তাকেও বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি বিরাগভাজন হয়েছেন ধর্মরাজদের। ক্যাথলিক চার্চের ধর্মরাজ তথা পোপদের কোপানলে পড়েছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানের ‘পাথ ফাইন্ডার’ এই বিজ্ঞানী। পৃথিবীর গতি সম্পর্কিত তার তত্ত্ব ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তার বিচার এবং শাস্তির ব্যবস্থা করে ধর্মরাজরা। এর আগে গ্যালিলিওকে স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে নয়, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। সক্রেটিসের মতো দৃঢ়চিত্ত ছিলেন না গ্যালিলিও। তাই আদালতে ধর্মরাজদের অত্যাচারের মুখে নতমস্তকে ‘কনফেশন’ করেছিলেন তিনি। অর্থাৎ গ্যালিলিও সত্যকে পাপ বলে মেনে নিয়েছিলেন। অথচ সময় দু’জনকেই নির্দোষ প্রমাণ করেছিলো। সক্রেটিস প্রমাণিত হয়েছিলেন আড়াই হাজার বছর পর, গ্যালিলিও সাড়ে তিনশো বছর পরে। দুই মনীষীর চিত্তের দৃঢ়তায় পার্থক্য ছিলো। সক্রেটিস মাথা নোয়াননি, মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিলেন, গ্যালিলিও করেছিলেন আপোস। নিজের আবিষ্কৃত সত্যকে মিথ্যা বলেছিলেন নিজেই। দৃঢ়চিত্ত আর নতচিত্ত এই দুই পার্থক্যের বিপরীতে তাদের মিলটা হলো, দু’জনই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন। তাদের তত্ত্ব, চিন্তা টিকে গিয়েছিলো। ভূমিকায় যাই বলুন না কেন, উপসংহারে সত্যটাই টিকে যায়।
দুই. আল মাহমুদ মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তার শরীরের রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদ করতে নেমে পড়েছেন একদল মানুষ। ব্যক্তির শরীর নশ্বর, তার সৃষ্টি অবিনশ্বর। ইহুদি নিধনযজ্ঞে হিটলারের সমর্থক ব্যক্তির সৃষ্টিকে, চিন্তাকে পাঠ করি, ভাবনায় আশ্রয় দিই আমরা। রবীন্দ্রনাথও মারাঠা দস্যু শিবাজীর বন্দনা করেছিলেন। ব্যক্তি আর সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখাটা প্রায়ই আমরা গুলিয়ে ফেলি। ঝামেলাটা বাধে তখনই।
হ্যাঁ, আল মাহমুদ হয়তো ‘সক্রেটিস চিত্তে’র ছিলেন না, ছিলেন গ্যালিলিও মানসিকতার। তাকে আপোস করতে হয়েছে, সংসার চালাতে হয়েছে, সন্তানদের ভরণ-পোষণ করতে হয়েছে। নিজের জন্য নয়, জীবনের প্রয়োজনে তিনি চাকরি বদল করছেন, অনেকের মতে আদর্শ বদল করেছেন। আমরা খুব সহজেই সবকিছু ‘ডিসাইড’ করে ফেলি। অথচ সক্রেটিসের নির্দোষিতা ডিসাইড করতে আড়াই হাজার বছর লেগেছিলো, আর গ্যালিলিওর সাড়ে তিনশো। আমাদের সাড়ে তিনশো সেকেন্ডেও লাগে না। সম্পূরক আরেকটি ব্যাপার হলো আমরা সৃষ্টি দিয়ে ব্যক্তিকে যাচাই না করে উল্টোটা করি। বড়ই বিচিত্র এই যাচাই প্রক্রিয়া।
ফুটনোট : আমার এক বন্ধু শিল্প-সাহিত্যের খুবই সমঝদার মানুষ। তার ঘরে সন্ধ্যার আড্ডায় নুসরাত ফতেহ আলী খান গাইছেন মিউজিক সিস্টেমে। জমে উঠেছে শিল্পের আড্ডা। বন্ধুটি তুমুল সমালোচনা করছেন আল মাহমুদের ব্যক্তি জীবনের। বাকিরাও সায় দিচ্ছেন। আমি ঝিম মেরে বসে পাকিস্তানি নুসরাত ফতেহ আলী খানের সমঝদার হবার চেষ্টা করছি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :